• বাঙালি ইস্যুতে গোয়েবলসের পথ ধরে হাঁটছে বিজেপি
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৫ জুলাই ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    নাৎসি জার্মানিতে হিটলারের প্রধান সহযোগী ছিলেন জোসেফ গোয়েবলস। তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর তত্ত্বই ছিল, একটি মিথ্যাকে বড় আকারে বারবার বলে যেতে হবে, আর তা সাধারণ মানুষ একদিন বিশ্বাস করতে শুরু করবে। ইহুদি বিরোধী প্রচারে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। জার্মানিতে যে ব্যাপক হারে ইহুদি নিধনযজ্ঞ হয়েছিল, তাতে হাত ছিল তাঁরই। গোয়েবলস প্রচার করতেন, জার্মানিতে হিটলারের মতো শক্তিশালী একজন শাসকের দরকার এবং তিনিই পারবেন জার্মান জাতির ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।

    গোয়েবলসের এই তত্ত্বের কথা বহুল প্রচারিত। আমাদের দেশে আরএসএস ও বিজেপি প্রায় অক্ষরে অক্ষরে এই তত্ত্ব অনুসরণ করে চলে। এ কথাও সুবিদিত। সাম্প্রতিককালে তাঁদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙালি। নির্বাচনের মাধ্যমে, সদুপায়ে পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে না পেরে, তারা এখন এক ভয়ঙ্কর গোয়েবলসীয় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। সারা ভারত জুড়েই তারা এখন প্রচার চালাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গ ভরে গিয়েছে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীতে। শুধু তাই নয়, এ বঙ্গের বিজেপি নেতারা সমস্বরে বলে যাচ্ছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠবে ‘পশ্চিম বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাস্তান’। সেই সঙ্গে ভারতে বাংলাভাষী মানুষজনকে তাঁরা বাংলাদেশি তকমা দিতে সক্রিয়। ফলস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বাঙালিদের চরম হেনস্থার ঘটনা ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ কর্মসূত্রে দেশের অন্যান্য রাজ্যে বসবাস করছেন। তাঁদের বাংলাদেশি বলে তুলে নিয়ে গিয়ে পুরে দেওয়া হচ্ছে জেলে। তাঁদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বা অন্যান্য পরিচয়পত্র গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না সেইসব রাজ্যের প্রশাসন। এমনকি ওইসব বাঙালির অনেককে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করে আবার দেশে ফিরেছেন। এ তো ভয়ঙ্কর অন্যায়! এ এক চূড়ান্ত অমানবিক ও অসংবেদনশীল প্রশাসনের নিদর্শন। একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের এই ঘটনার পেছনে যে ভারতব্যাপী একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কাজ করছে, তা স্পষ্ট। বিশেষ করে এর পেছনে রয়েছে বিজেপির চক্রান্ত।

    এর ফলে অন্যান্য রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনেও এই ধারণা দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে, বাংলাভাষী মাত্রেই বাংলাদেশি। বড় পরিতাপের বিষয়, অবাঙালিদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা রয়ে গেছে। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই দুর্গাপুরে সম্প্রতি তাঁর ভাষণে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার কথা খানিকটা স্বীকার করেছেন।

    উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। তার মধ্যে এখনও প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। এই সম্পূর্ণ সীমান্তের দায়িত্বে রয়েছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ, যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখা এবং অনুপ্রবেশ ও চোরাকারবার বন্ধের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিএসএফ-এর তথা কেন্দ্রীয় সরকারের। স্বাভাবিকভাবেই, অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার দায় এড়াতে পারে না। অনুপ্রবেশের ব্যাপারে প্রবল সরব অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। অসমে তো ডবল ইঞ্জিন সরকার। তাহলে সেখানে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে কীভাবে? এতকাল তো অসমে তাঁরা দাবি করে আসছিলেন, বাংলাদেশে এক কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। কিন্তু অসমের এনআরসি প্রমাণ করে দিয়েছে, ওই দাবি কতো অবান্তর ও ভিত্তিহীন। সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, কোথাও উন্নয়নের নামে, কোথাও বাংলাদেশি হিসেবে।

    এ রাজ্যেও বিজেপির নেতারা ওইরকম একই দাবিতে সরব। তাঁদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আসলে এ তাঁদের গোয়েবলসীয় প্রচার। পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ বাঙালি মুসলমান। বংশানুক্রমিকভাবেই তাঁরা এখানকার ভূমিপুত্র। তাঁদের ধর্ম ইসলাম হলেও, তাঁরা হিন্দু-মুসলমান সমন্বিত বাঙালি সংস্কৃতির সম্পূর্ণ অংশীদার। বাংলার গ্রামীণ হিন্দু-মুসলমান আজন্ম এই সংস্কৃতিতেই লালিত-পালিত। নিজস্ব ধর্ম পালন করেও পরস্পরের মধ্যে মানুষ হিসেবে তেমন কোনও দূরত্ব বা বিদ্বেষ পোষণ করেন না তাঁরা। অবশ্য ইদানিং ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনীতি তাঁদের মধ্যে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে। একদিকে বিজেপির ‘হিন্দু-হিন্দু ভাই ভাই’ প্রচার, অন্যদিকে, মাদ্রাসা-কেন্দ্রিক ধর্মান্ধতা নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ঊর্বর ভূমি তৈরি করছে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে বলেই তাঁরা জঙ্গি বা দেশদ্রোহী হয়ে উঠছে, এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের গুলিয়ে ফেললে চলবে না।

    পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক মৌলবাদীদের চক্রান্তে কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও, সাধারণ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁরা পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পরস্পরকে রক্ষা করেছেন। এটাই এ বাংলার ঐতিহ্য। আর সে কারণেই এখানে সেভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের ঘটনাতেও দেখা গিয়েছে– হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বলছেন, প্রতিবেশী মুসলমানরা তাঁদের রক্ষা করেছেন, আবার মুসলমানরাও বলছেন, পাশের হিন্দু প্রতিবেশীরা তাঁদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ এই কথাগুলি সেভাবে প্রচারিত হয়নি। তার বদলে রাজনৈতিকভাবে তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন ন্যারেটিভ। আর তাকেই বিপুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। ফলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সেই  ন্যারেটিভই বিশ্বাস করেছেন।

    আসলে নিজের রাজ্যের মানুষজন সম্পর্কে বহু মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে বিজেপি-আরএসএস গোয়েবলসীয় রীতিতে উচ্চকিতভাবে যে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভারতে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বাঙালি। গত সাত মাস ধরে মহারাষ্ট্রের জেলে বন্দি রয়েছেন রানাঘাটের মতুয়া সম্প্রদায়ের দুই ভাই। ওড়িশা জেল থেকেও ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালিদের প্রতি নির্যাতন আরও বাড়বে। এর ফলে বহু পরিযায়ী শ্রমিক ওইসব রাজ্য থেকে প্রাণ ভয়ে রাজ্যে ফিরে আসতে চাইছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের জুজু দেখিয়ে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করতে চাইছে বিজেপি-আরএসএস। এ ব্যাপারে তারা গোয়েবলসের পথ ধরেই এগোচ্ছে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)