• দেশজুড়ে বাঙালিকে কোণঠাসা করাই এখন বিজেপির প্রধান কর্মসূচি
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৭ জুলাই ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    কোনও ছোট দেশ থেকে পার্শ্ববর্তী বড় দেশে বিভিন্ন কারণে অনুপ্রবেশের প্রবণতা দেখা যায়। তার মূল কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। ভারতের পাশে অপেক্ষাকৃত বড় কোনও দেশ থাকলে নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের সেখানে অবৈধভাবে হলেও চলে যাওয়ার ছবি দেখা যেত। এই ধরনের অনুপ্রবেশ কম-বেশি সব দেশেই হয়ে থাকে। এ সমস্যা সারা পৃথিবীর। কিছুদিন আগেই তো আমরা দেখেছি, আমেরিকা থেকে মার্কিন বিমানে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে দফায় দফায় আহমেদাবাদ ও অমৃতসর বিমানবন্দরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব ভারতীয়দের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করেছে মার্কিন সরকার, তার বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

    বাংলাদেশ থেকে এপারে যে অনুপ্রবেশ একেবারে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু বিজেপির পক্ষ থেকে যে পর্যায়ের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়। সীমান্ত এলাকার দায়িত্ব বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের, যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। কিন্তু এ কথা সুবিদিত যে, দীর্ঘকাল ধরেই অনুপ্রবেশ এবং চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত থাকে বিএসএফ-ও। টাকা-পয়সার বিনিময়ে তারা সাহায্য করে এইসব দুষ্কৃতীদের। কেন্দ্র সরকার কি সে কথা জানে না? গত ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা মোদী সরকার এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? সাধারণ পর্যটকদেরও স্থলসীমান্ত পেরোতে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজের লোকেরা যেভাবে হেনস্থা করেন, তা সকলেরই জানা। ন্যূনতম একশো থেকে তিনশো টাকা পর্যন্ত ঘুষ না দিলে নিরপরাধ পর্যটকদের নিস্তার নেই। এ ভয়ঙ্কর লজ্জার কথা। কিন্তু বছরের পর বছর এ বিষয়ে জেগে ঘুমোয় কর্তৃপক্ষ।

    অসমে অনুপ্রবেশ নিয়ে সরব সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁদের দাবি, দু’কোটি বাংলাদেশি রয়েছে অসমে। এ এক চূড়ান্ত মিথ্যা প্রচার। সাম্প্রতিক এনআরসি-তে তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। সেই পথ ধরেই পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি নেতারা ওই একই অপপ্রচারে ক্রমাগত সুর চড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু তার বাস্তবসম্মত প্রমাণ তাঁদের হাতে নেই। এ কথা সত্য, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু অনুপ্রবেশের প্রমাণ প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু তার সংখ্যা নগণ্য।

    অতি সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য আলোচনাসভায় (নাকি কলহসভায়) ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক লেখিকা তাঁর স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। তাদের ভাষা, খাদ্য কোনও কিছুর সঙ্গেই ভারতীয় সংস্কৃতির মিল নেই। মজার কথা, কোথায় তিনি এই উপনিবেশ দেখেছেন, তার কোনও উল্লেখ করেননি। তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ভিনরাজ্যে বাংলা ভাষায় কথা বললেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে– এসব ভুয়ো খবর। সঞ্চালক মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে মাথা নেড়ে ওই লেখিকাকে সমর্থন জানাচ্ছিলেন, তিনিও বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে লেখিকার কথার বিরোধিতা করতে বাধ্য হলেন। লেখিকা সুর চড়ালেন, বাংলা বলার জন্যই অন্য রাজ্যে যে বাঙালিদের হেনস্থা করা হচ্ছে, তার জন্য কি তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে?

    এ কথা খুব স্পষ্ট এবং বিজেপি নেতারা বাঙালি সম্পর্কে যে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, ওই লেখিকা অবিকল সেই সুরেই সুর মিলিয়েছেন। এর কারণ কী থাকতে পারে, তা সাধুজন বুঝে নিন। সাংবাদিক অজিত আনজুম তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে হরিয়ানার গুরুগ্রামের বাঙালি শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। সেখানকার শ্রমিক কলোনিতে বাঙালি শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁরা জানিয়েছেন, বাংলায় কথা বলা শুনলেই পুলিশ তাঁদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে থানায়, আর তাঁদের কাছ থেকে দাবি করছে মোটা অঙ্কের টাকা। তা দিতে না পারলে কেস দিয়ে তাঁদের কোর্টে তোলা হচ্ছে। আর শাস্তি হিসেবে তাঁদের জেলে যেতে হচ্ছে অন্তত দু’তিন মাসের জন্য। এছাড়াও পুলিশ তাঁদের আটকে রেখে মারধর করে, জল পর্যন্ত খেতে দেয় না। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড এবং অন্যান্য প্রমাণপত্র দেখালেও তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না পুলিশ। অথচ এর কোনও প্রতিকার নেই। এখন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তৃণমূল সাংসদেরা ওইসব বিপন্ন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ওইসব শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকার বাসিন্দা, সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনও তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিশ্চিত করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, একজন ভারতীয় বাঙালি নাগরিক কেন ভারতেরই অন্য রাজ্যে এরকম অত্যাচারের মুখে পড়বেন? আসলে দেশজুড়েই বাঙালিদের কোণঠাসা করার এবং তাঁদের একটা বড় সংখ্যাকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চক্রান্ত চালাচ্ছে বিজেপি।

    অতি সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এরকম ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ভোটার তালিকা সংশোধন নিশ্চয় খুব জরুরি এবং তা সারাবছর ধরেই হওয়া উচিত। কিন্তু একুশ বছর পর বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে ৫৭ লক্ষ নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের এবং যাঁরা স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে গিয়েছেন, তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে। কিন্তু একুশ বছরের তথ্য নির্বাচন কমিশন মাত্র দু’তিন দিনে কীভাবে মিলিয়ে নিতে পারল? এ নিছক প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। জানা গিয়েছে, যাদব সম্প্রদায়ের মানুষের নাম সবচেয়ে বেশি বাদ গিয়েছে, কারণ তাঁরা বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক নয়। এরপর নির্বাচন কমিশনারের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ। আসন্ন নির্বাচনের আগে এখানেও ভোটার তালিকায় এই ধরনের কাণ্ড ঘটানো হবে। আর তাই বিজেপি সমস্বরে অনুপ্রবেশের ভুয়ো তত্ত্ব প্রচারে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা, অসমের বাঙালিদের মতোই বিজেপির এই প্রচারের শিকার হবেন, এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিজেপি হিন্দু ধর্মের কথা বলে বলেই বাঙালি হিন্দুরাও যে এর থেকে ছাড় পাবেন, তা মনে করার কোনও কারণ নেই। অসমের এনআরসি তার বড় প্রমাণ।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)