সকাল থেকেই বৃষ্টি। ইটের গাঁথনি আর অ্যাসবেস্টস-টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ির বারান্দায় বসে প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী চন্দনা সিং ওরফে শোভা মুন্ডা। গল্প জুড়েছেন ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে। কখনও খেলছেন পোষা টিয়াপাখিটার সঙ্গে। সে-ও বন্দি নয়, মুক্ত-বিহঙ্গ।
শুক্রবার সকাল। ১৫ বছর বাদে জেল থেকে ফিরে বেলপাহাড়ির মাজুগোড় গ্রামের বাড়িতে সবে ১২ ঘন্টা কাটিয়েছেন। কথায় কথায় ফিরলেন অতীতে।জানালেন, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পড়া এগোয়নি। বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই মাওবাদীদের খাতায় নাম লেখান। সে দলেই তাঁর নতুন নাম হয় শোভা। তবে এখন আক্ষেপ, ‘‘ওদের (মাওবাদী) সাহায্য করাই কাল হল।প্রতিবাদ না করলে পাঁচজনের মতো সাধারণ জীবন কাটাতে পারতাম।’’
বদলেছে চারপাশ। শোভার কথায়, ‘‘আগে এত বাড়ি ছিল না। এখন সরকার বাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু এত কম টাকায় কী করে বাড়ি হয়?’’ আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি পেয়েছেন শোভার দাদা তারক সিং। কিন্তু বাড়িটি অসম্পূর্ণ। তা দেখিয়ে শোভার মন্তব্য, ‘‘ঢালাই পর্যন্ত করতে পারেনি। তিন বছর ধরে পড়ে রয়েছে।’’ জঙ্গলমহলের যে উন্নয়ন নিয়ে এত চর্চা, যে উন্নয়ন সত্যিই চেয়েছিলেন শোভারা, তা-ও হয়নি বলেই দাবি একদা মাওবাদী নেত্রীর। শোভার প্রশ্ন, ‘‘রাস্তাঘাট আর কিছু বাড়িই কি প্রকৃত উন্নয়ন? মানুষের কাজ কই? কাজ না পেলে অর্থনৈতিক অবস্থার বদল কী ভাবে হবে?’’
বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। কানে আসছে ময়ূরের ডাক। ভিজেই কাঠের বোঝা মাথায় বাড়ি ফিরলেন শোভার বৌদি ছবি সিং। পরে কাদা মেখে ঢুকলেন দাদা তারক। তাঁদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। শোভার মা লক্ষ্মী সিং বাপের বাড়ি ভুলাভেদাতেই থাকেন। তিনি মনোরোগে ভুগছেন। শোভা বিবাহিত। তবে স্বামী শিলদা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।
মাওবাদীদের স্কোয়াডের বেশিরভাগই তো আত্মসমর্পণ করে সরকারি প্যাকেজে চাকরি পেয়ে জীবনের মূলস্রোতে ফিরছেন। আপনি কী ভাবছেন? শোভার জবাব, ‘‘আমি তো আত্মসমর্পণ করিনি। ১৫টা বছর জেলেই কেটেই গেল। আগামী দিনে কী করব এখনও ভাবিনি। মাস চারেক শান্তিতে পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চাই।’’ তৃণমূলে যাবেন নাকি? এক গাল হেসে শোভার জবাব, ‘‘তাহলে লোকে ঝাঁটাপেটা করবে।’’
তারক অবশ্য বললেন, ‘‘চাকরির জন্য বোনকে বোঝাব।’’ প্রতিবেশী নরেন সিংয়ের কথায়, ‘‘অনেক বছর বাদে মেয়েটা ফিরেছে। ভাল লাগছে।’’ বৃষ্টিভেজা দিনে দুপুরের মেনুতে ছিল মাংস-ভাত। ছবি বললেন, ‘‘কাল রাতেই মাংস রাঁধতে চেয়েছিলাম। ননদই রাজি হল না।’’