• ক্যাম্পাসে ছড়ি ঘোরান গবেষক নেতারাও
    আনন্দবাজার | ২৭ জুলাই ২০২৫
  • শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার জোর কাকে বলে তা স্রেফ সাধারণ শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরাই দেখেন না। ভবনের মেঝেয়,দালানেও বোঝা যায়।

    জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মভিটেয় দক্ষিণের বারান্দার ঠিক নীচেই তৃণমূল শিক্ষাকর্মীদের ইউনিয়ন ঘর গড়ে উঠেছিল। তোলপাড় হয় হাই কোর্টে। ঘরময় সবুজ রং লেপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে সাজানো হয়েছিল। হেরিটেজ গ্রেড এ বাড়ির ঘরটির দেওয়াল, মেঝেয় খোঁড়াখুঁড়ির অভিযোগও ওঠে। পরে তা সারিয়েছিলেন তৎকালীন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার প্রশাসনের তরফে তৃণমূল শিক্ষাকর্মী ইউনিটের প্রধান সুবোধ দত্তচৌধুরী এবং গবেষণারত ছাত্রনেতা বিশ্বজিৎ দে ওরফে বাপ্পাকে শিক্ষাঙ্গন থেকে বহিষ্কার করা হয়। বাপ্পা পরে শুধুমাত্র পিএইচ ডি-র নির্দিষ্ট কাজে ঢোকার অনুমতি পান।

    কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে পড়ে থাকা আব্দুল কাইয়ুম মোল্লা বা রবীন্দ্রভারতীর বাপ্পাদের জন‍্য ধারাবাহিক ভাবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা শাসক দলের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেননি নেতৃত্ব। ৭-৮ বছর আগেও কাইয়ুম পর পর কিছু বিদেশি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সের নাম করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতেন। এখনও নানা গোলমাল, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে তাঁর নাম জড়ায়। ৭-৮ বছর আগে সেন্ট পলস কলেজের এক ছাত্রকে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে ধৃত কাইয়ুম আজও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ‍্য সম্পাদক। বাপ্পাও উত্তর কলকাতায় টিএমসিপির সভাপতি। বাপ্পা অবশ‍্য বলছেন, “রবীন্দ্রভারতীতে আর রাজনীতি করতে চাই না।”

    সাম্প্রতিক অতীতে কাইয়ুম এবং টিএমসিপি-র আর এক রাজ‍্য সম্পাদক অভিরূপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার অভিযোগে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরে কলেজ স্ট্রিটে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে বহিরাগতদের আনাগোনায় নিষেধ করেছে হাই কোর্ট। তাতেও সমস্যা মেটেনি। কাইয়ুমের দাবি, “আসলে দলের ঘনিষ্ঠরাও অনেকে চায় না আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করি। আমার বিরুদ্ধে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগও প্রমাণ হয়নি। আমি এখন পড়াশোনার মধ‍্যে নেই। শুধু যারা টিএমসিপি করে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ক‍্যাম্পাসের গেটের কাছে আসি!”

    টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি ৩৪ বছরের তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলছেন, “দলের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছাত্র রাজনীতির বয়সটা আমরা ৩৫ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি।” কিন্তু বাস্তবে এখনও চল্লিশোর্ধ্ব কেউ কেউও সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদেই রয়েছেন। শাসক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েক জন ছাত্রনেতাই বছরের পর বছর ক‍্যাম্পাস আঁকড়ে থাকতে পিএইচ ডি-ঢাল বেছে নিচ্ছেন। স্নাতকোত্তর, এমবিএ ইত্যাদি পড়ার পরে যাঁরা পিএইচ ডি-তে ঢোকেন, তাঁরা অনেকেই ত্রিশের কোঠায়। আবার অনেকে গবেষক বলে ক্যাম্পাসে চাউর হলেও বাস্তবে তাঁরা কী করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ ক‍্যাম্পাসে এক নেতা ‘হিউম‍্যান রাইটস’-এর গবেষক বলে পরিচিত। বাস্তবে কিছুই করেন না বলে অভিযোগ। নানা গোলমাল, উত্তেজনায় থেকে থেকে তাঁর নাম উঠে আসে। আবার আলিপুর ক‍্যাম্পাসে ম্যানেজমেন্টে পিএইচ ডি-রত এক ডাকাবুকো ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রছাত্রীদের একাংশের বহু অভিযোগ। বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তনী কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্য নামের গবেষক-নেতার কথায়, “অন্যায়ের প্রতিবাদ করি বলেই কিছু বদনাম সইতে হয়।”

    শাসক দলের ঘনিষ্ঠ গবেষকেরাই অনেক সময়ে শিক্ষক বা গাইডদের কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে বলেও অভিযোগ ওঠে। তৃণাঙ্কুরের ব্যাখ্যা, “গবেষকের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে শিক্ষকেরা একটু বাড়তি সচেতন থাকেন বলা যেতে পারে। অনেক সময়ে গবেষকের উপরে গাইডের জুলুমের যে অভিযোগ শোনা যায়, গবেষক নেতারা তার থেকে সুরক্ষিত। এর বেশি কিছু নয়।” তৃণাঙ্কুর নিজে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর ধরে মাইক্রোবায়োলজির গবেষক। রাজনৈতিক পরিচয়ের দরুন গবেষণার সমস্যার উল্টো দিক তুলে ধরে তিনি বলছেন, “আমায় কিন্তু ভবিষ্যতে গবেষণার প্রতিটি স্তরে আরটিআই হতে পারে ভেবে সতর্ক থাকতে হয়। মাসে গড়ে দু’-তিন দিন কাজটা করতে আসানসোলে যাই। ফিল্ডে বা স্যরের বাড়িতে— গুগল লোকেশন বসিয়ে কিছু ছবি তুলে রাখতে ভুলি না।”

    তবে ঝক্কি যাই থাক, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র প্রাক্তনী ছাত্রনেতারাই ক্যাম্পাসে কার্যত সেঁটে থাকেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকলেও পরিচালন সমিতি বা জিবি-র সভায় ছাত্রনেতাদের অবাধ বিচরণের অভিযোগ বেশ কিছু কলেজেই। অনেকে বলেন, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু নয়, টাকার গন্ধও এর পিছনের কারণ। খাতায়-কলমে কলেজে নানা খাতে ছাত্রছাত্রীদের খরচ বছরে ১২-১৪ হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু ভর্তি থেকে শুরু করে বিভাগ পাল্টে পছন্দসই কোথাও ঢোকা, নানা খাতে টাকা আদায়ের অভিযোগ রাজ‍্য জুড়ে নানা কলেজেই ওঠে। কলেজ তহবিলে কোথাওই ৮ থেকে ৩০ লক্ষের বেশি থাকে না। জিবির মদতে আকছার তাতেও অধিকার ফলান ছাত্রনেতারা। কসবার আইন কলেজেও যা ঘটছিল।

    উত্তর কলকাতার একটি কলেজে নানা কাজের টেন্ডার প্রাক্তনী নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে শোনা যেত। তাঁদের এড়িয়ে কর্তৃপক্ষ পূর্ত দফতরকে দিয়ে কাজ করালেও বিস্তর ঝামেলা পাকিয়ে দাদাদের সব ভণ্ডুল করার অপচেষ্টারও নমুনা আছে। সম্প্রতি ঘাটালের একটি কলেজে তৃণমূল ছাত্র নেতাদের ভুয়ো ভর্তি বিল দেখিয়ে টাকা তোলার দুর্নীতি ফাঁস করে এসএফআই। তাদের দাবি, জেলায় জেলায় ২১ জুলাই বা ২৮ অগস্ট, প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনে টিএমসিপি-র খরচের ভাঁড়ার বিভিন্ন কলেজ থেকেই উঠে আসে। প্রত‍্যাশিত ভাবেই যা উড়িয়ে দিয়েছে টিএমসিপি নেতৃত্ব। তৃণাঙ্কুরের দাবি, “গত ৭ বছরে ভর্তি দুর্নীতি বন্ধ করায় নিজেকে সফলই বলব। ১০০ শতাংশ পারিনি। কিন্তু খোলাখুলি ও সব চলে না।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)