• সিপিএমের ‘হার্মাদ বাহিনী’র ভয়ে জঙ্গলে রাত্রিযাপন, প্রতিবাদের পথ হয়ে ওঠে মাওবাদ! স্মৃতিচারণ শোভার
    প্রতিদিন | ২৮ জুলাই ২০২৫
  • সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: দু’দিন পর গ্রামের মাটিতে পা দিলেন। ঘুরে দেখলেন নিজের চেনা পাড়া সব যেন বদলে গিয়েছে। বৃষ্টিভেজা নরম মাটি আর জমিতে সদ্য রোপন করা কচি ধানের সবুজ চারাগুলির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন আনমনা। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামে ফিরেছেন প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী শোভা মুণ্ডা ওরফে চন্দনা সিং। গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বয়সের কথা মনে পড়ছে তাঁর। মনে পড়ে বাম আমলে সিপিএমের ‘অত্যাচারে’র কথা।

    বেলপাহাড়ির গ্রামে বাম সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় অত্যাচার হত বলে অভিযোগ। সিপিএমের ‘হার্মাদ বাহিনী’র ভয়ে রাতের অন্ধকারে গভীর বনের মধ্যেও সপরিবারে থাকতে হয়েছে বলে অভিযোগ। সেসব দিনের কথা এখনও শোভার চোখে জ্বলজ্বল করে। শোভা বলেন, “হার্মাদদের কথা না শুনলে হাতের আঙুল কেটে নিত ওরা। সে এক ভীষণ অত্যাচার। দাদাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরেছে। আর সহ্য হল না। তাই একদিন মুক্তি পাওয়ার আশায় পালালাম।” ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে শোভার মুখের ভাব বদল হয় এখনও। শোভা জানিয়েছেন, সিপিএমের ‘হার্মাদ বাহিনী’র ভয়ে কিশোর দাদা তারক-সহ পুরো পরিবার জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত রাতের পর রাত।

    বাড়ির থেকে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল চন্দনা। সেই নামটি আজও তাঁর বড় প্রিয়। মাওবাদী স্কোয়াডে পাওয়া নাম ‘শোভা’ বোঝার মতো বয়ে বেড়িয়েছেন ২০ বছর। এই নামের ভাড় চেপে বসেছে। বছর বারোর বালিকার কিশোরী জীবন বদলে গিয়েছে। এখন তিনি ৩৩ বছর বয়সের যুবতী। মাঝের দুই দশক কাটিয়ে দিয়েছেন জঙ্গল আর সংশোধনাগারে। ছোটবেলা থেকেই অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। প্রতিবাদ করে উঠতেন। সেই স্বভাবের জন্য বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীরাও খেপি নামে ডাকতেন বলে খবর। সেই নামও এখনও তাঁর প্রিয়।

    সংশোধনাগার থেকে মুক্তির পর শোভার দিন কয়েক কেটে গিয়েছে মাজুগোড়া ভূমিজ সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামের বাড়িতে। পাড়ার আত্মীয়-পরিজনরাও যেন কেমন অন্যরকম ঠাওর হয়। চেনা যায় না মুখ। বাচ্চাদের গাল টিপে আদর করতে গিয়েও যেন আড়ষ্ঠ ভাব। পরিবারের লোকজনদের সঙ্গেই থাকতে নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তিনি। চারদিকের দুনিয়া কেমন যেন বদলে গিয়েছে। মাজুগোড়া ভূমিজ সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামটিকে বেলপাহাড়ির-বান্দোয়ান পিচ রাস্তাটি মাঝামাঝি ভাগ করে দিয়েছে। শোভাদের দিকের পাড়াটা বেশ ছোট, ১০-১২ ঘর মানুষের বাস। এদিন রবিবার বাড়ি ফেরার দুদিন পর নিজেদের যেটুকু সামান্য চাষের জমি আছে, তা দেখতে বেরিয়েছিলেন শোভা। একা থাকলে মনে পড়ে স্বামী রাজেশ মুণ্ডার কথা। ২০০৯ সালে মাওবাদী স্কোয়াডে থাকাকালীন ঝাড়খণ্ডের রাজেশ মুণ্ডার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। মাত্র একবছর একসঙ্গে থাকতে পেরেছিলেন। ২০১০ সালে কোনও এক দোকানে জিনিস কিনতে গিয়ে ১৭ বছর বয়সে ধরা পড়ে যান পুলিশের হাতে। একসময় স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ভিডিও কলে বহরমপুর জেলে বন্দি স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। শেষবার গত ১২ জুলাই মুক্তি পাওয়ার কথা স্বামীকে জানাতে পেরেছিলেন শোভা। এখন শোভা স্বামীর মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

    গ্রামের অপরপাড়ার ছোটবেলার খেলার সঙ্গী যমুনা সিং সর্দার। তিনিও নাম লিখিয়েছিলেন মাওবাদী স্কোয়াডে। শোভার থেকে কয়েক বছরের বড় যমুনার বিয়ে হয়েছিল বেলপাহাড়ি শিমূলপাল অঞ্চলের পাথরচাকড়ি গ্রামে। একটা ছেলেও রয়েছে তাঁর। শোভার গ্রেপ্তারের বছর খানেকের মধ্যেই যমুনা ধরা পড়েন। জামসেদপুরের জেলে পাশাপাশি ওয়ার্ডে থাকতেন তাঁরা। শোভা বলেন, “২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা একই জেলের পাশাপাশি ওয়ার্ডে থাকতাম। দু’জন ছোটবেলার কত গল্প করতাম। পুরনো সব স্মৃতি ভিড় করে আসত। যমুনা ছাড়া পেলে খুব ভালো লাগবে।”
  • Link to this news (প্রতিদিন)