• উচ্চ শিক্ষার পর চাকরির স্বপ্ন ভুলছে নবপ্রজন্ম, উচ্চ মাধ্যমিক শেষে পড়ুয়ারাও পরিযায়ী শ্রমিক, ফাঁকা কলেজ
    বর্তমান | ২৮ জুলাই ২০২৫
  • শ্রীকান্ত পড়্যা, তমলুক: ‘কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে কী করব? উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট বাড়িতে থাকলে পেট ভরবে?’ একনাগাড়ে প্রশ্নগুলি ছুড়ে দিচ্ছিলেন তমলুকের কুলবেড়্যা ভীমদেব আদর্শ বিদ্যাপীঠের শুভদীপ সামন্ত, সাহেব বেরা ও শিবরাম সর্দার। তাঁরা প্রত্যেকে এবছর ওই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। পাশ করার পর কেউই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী নন। নিমতৌড়ির বাসিন্দা শুভদীপ দিল্লির একটি কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছেন। সাহেবের এখন কর্মস্থল রাজস্থান। সেখানে সোনার কাজ করেন। আর উত্তর সোনামুই গ্রামের শিবরাম উত্তরপ্রদেশে কাজে যুক্ত হয়েছেন।

    শুভদীপ, সাহেবদের মতো এবছর ওই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ১৫জন ভিনরাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক। পায়রাচলির দেবাশিস পাত্র বেঙ্গালুরুতে ফুলের কাজে যুক্ত হয়েছেন। উত্তর সোনামুইয়ের শেখ মেহতাব ওড়িশায় টাইলস বসানোর শ্রমিক। অথচ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনিক ভবন থেকে মাত্র ১০০মিটার দূরে এই স্কুল। তমলুকের ডিএম অফিসে কোনও অনুষ্ঠানে এই স্কুলের পড়ুয়াদের ডাকা হয়। তাঁদের নিয়ে সচেতনতা শিবির চালায় প্রশাসন। কিন্তু, সেই স্কুলে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ৭২জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ১৫জন পরিযায়ী শ্রমিক। অন্তত ১২জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বেরা বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বেশিরভাগই রোজগারের জন্য নানাপ্রান্তে পাড়ি দিয়েছে। তারা জানে, উচ্চশিক্ষা লাভ করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। কিন্তু, তাতে বিশেষ কাজে আসবে না। 

    শুধু কুলবেড়্যা ভীমদেব আদর্শ বিদ্যাপীঠ নয়, তমলুক শহর ঘেঁষা কেলোমাল সন্তোষিনী হাইস্কুলেও একই ছবি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর অনেক পড়ুয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ না দেখিয়ে হোটেল, কাপড়ের দোকান, সেলুনে কাজে যুক্ত হয়েছেন। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃন্ময় মাজি বলেন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করার পর চাকরি নেই। তাই উচ্চশিক্ষায় বিমুখ হয়ে পড়ছে একটা বড় অংশের ছাত্রছাত্রী। ট্যাবের লোভে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও ক্লাসে অনিয়মিত থাকে অনেকে। ট্যাব পাওয়ার পর অনেকে ড্রপআউট হয়। 

    ২০২৫সালে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় মোট ৫৮হাজার ৪২১জন ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত এই তিন জেলায় মোট ৫২টি কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ২৮হাজার ২২১জন। অর্থাৎ তিন জেলায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা অর্ধেক পড়ুয়াও কলেজে ভর্তির আগ্রহ দেখায়নি। তিনটি স্বশাসিত কলেজে অবশ্য কিছু পড়ুয়া ভর্তি হয়েছেন। তবুও পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা বহু ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিয়ে উদাসীন। তার কারণ, স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং বিএড কোর্সের পর চাকরির দিশা নেই। ২০১৬সালের পর থেকেই শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়নি। ন’বছর আগে শিক্ষক নিয়োগ হলেও প্যানেল বাতিলের জেরে যুব সমাজ আরও হতাশ। তাই কলেজ ফাঁকা পড়ে থাকছে। ভরা ক্লাসরুমের সেই ছবি উধাও। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসন সংখ্যা একধাক্কায় অনেকটাই কমিয়ে দিতে চাইছে।

    বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৫২টি কলেজে মোট আসন ৭৪হাজার ৩৮১। অথচ, ভর্তির জন্য মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ২৮হাজার ২২১জন। প্রত্যেকে ভর্তি হলেও ৪৬হাজার আসন ফাঁকা থাকবে। অতীতে কোনওদিন শিক্ষায় এগিয়ে থাকা মেদিনীপুরে এই ঘটনা ঘটেনি। তমলুক থেকে পটাশপুর, কাঁথি থেকে এগরা সব জায়গায় কলেজে মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা তার চেয়েও কম আবেদন এসেছে। দিন দিন ছবিটা আরও খারাপ হচ্ছে। হতাশ হচ্ছে যুব সমাজ।
  • Link to this news (বর্তমান)