চৌর্যবৃত্তি দারুণ এক শিল্পকলা! ধরা পড়ে মান-ইজ্জত খুইয়ে আফশোস সৌমাল্যর
বর্তমান | ২৯ জুলাই ২০২৫
প্রদীপ্ত দত্ত ঝাড়গ্ৰাম
চৌর্যবৃত্তিকে একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল ইংরেজিতে এমএ পাশ সৌমাল্য চৌধুরী। ফলত, দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় চুরি করেও দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। তাঁর টিঁকিটিও ছুঁতে পারত না তাবড় পুলিসকর্তারা। এ নিয়ে সৌমাল্যের মধ্যে একটা অহঙ্কারবোধ ছিল। নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ চোর বলে প্রচার করত সাগরেদদের কাছে। তাদের চুরিবিদ্যার পাঠ দিত। এরজন্য নিজের ডেরায় একটি কেন্দ্রও খুলে ফেলেছিল। সেখানে হাতে-কলমে চুরির প্রশিক্ষণও দিত সৌমাল্য। মোবাইল ও সিসি ক্যামেরাকে কীভাবে জব্দ করতে হবে, তার উপর বেশি জোর দিত সে। ঝাড়গ্রামে ধরা পড়ে তার মান-ইজ্জত সব গিয়েছে! পুলিসি জেরায় এখন আফশোস করছে হাই প্রোফাইল চোর।
ঝাড়গ্রামের এসডিপিও শামীম বিশ্বাস বলেন, ‘জেলায় জেলায় ওর দলের সদস্যরা ছড়িয়ে। সন্দেহভাজন অনেককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ধৃতরা চুরির সঙ্গে অনান্য দুষ্কর্মে জড়িত ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
অল্প বয়স থেকেই চুরিবিদ্যায় দক্ষ ছিল সৌমাল্য। নিপুণ কৌশলে অন্যের জিনিস ঝেপে দিত। পাশাপাশি পড়াশোনায়ও বেশ মেধাবী। ইংরেজিতে এমএ পাশ করেই রেলের চাকরি। কিন্তু দশটা-পাঁচটা বৈচিত্রহীন ডিউটি ছিল তার না-পসন্দ। বাবা ও মা ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। উল্টে মায়ের যাবতীয় গয়না হাতিয়ে বেচে দেয় সৌমাল্য। সেই অপরাধে রেলের চাকরটি খোয়াতে হয়। ছেলের এই কুকীর্তি সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন তার মা। পুলিসের কাছে তার অকপট স্বীকারোক্তি, মায়ের গয়না চুরি তার কাছে শাপে বর হয়েছিল। চুরিবিদ্যায় একঝাঁক পারদর্শী যুবককে গড়েপিটে নিতে পেরেছে। চুরির পাঠ দিতে গিয়ে তাদের শিখিয়েছে মনকে বশে রাখার কৌশল। পুলিসকে জানিয়েছে, জানেন তো চুরির কাজে মনের বড় ভূমিকা রয়েছে। এর জন্য মনোবিজ্ঞান নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করেছে বিস্তর। ইংরেজিতে মনোবিদ্যার পাঠও দিত সাগরেদদের। বুঝতে না পারলেও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের মাথা নত হয়ে যেত। সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সৌমাল্য। মনোবিজ্ঞানে তার বিরাট বুৎপত্তি দেখে তাজ্জব বনে যাচ্ছেন দুঁদে পুলিসকর্তারাও। যেমন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মফঃস্বলের আবসনকেই কেন টার্গেট? সমাজ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের মিশেলে তার জবাব ছিল—মধ্যবিত্তদের যৌথ পরিবার ভাঙছে। তারা বড় আবাসনে থাকছে। কিন্তু পাড়া কালচারে অভ্যস্ত বাসিন্দারা এখনও আবাসন সংস্কৃতিকে মানাতে পারেনি। তাই ফ্ল্যাটে সদ্ভাবের অভাব। আড্ডা মারার ফুরসৎ নেই কারও। আবাসনে কে কখন আসছে, যাচ্ছে, তার খোঁজ রাখে না কেউ। সিসি ক্যামেরা, নিরাপত্তীরক্ষী রাখার ব্যয় নিয়ে চলে টানাপোড়েন। এই কয়েকটা কারণই মফঃস্বলের আবাসন চুরির আদর্শ জায়গা বলে পুলিসকে জানিয়েছে সৌমাল্য।
প্রাচীন যুগে ‘ষন্মুখকল্পম’নামে জনপ্রিয় চৌর্যশাস্ত্র ছিল। তস্কর বা চোররা সেটি পাঠ করে চৌর্যকর্মে পারদর্শী হয়ে উঠত। সেখানে বলা রয়েছে—‘রাত্রি দেব কার্তিককে স্মরণ করে চুরির কাজে বেরোতে হবে। গৃহস্থের ঘুমের গভীরতা জরিপ করতে হবে বাড়ির বাইরে থেকে।’ জেলার রসিক এক পুলিসকর্তা বলছিলেন, ‘আধুনিককালে একটা চৌর্যশাস্ত্র লিখতেই পারে সৌমাল্য।’