অন্ধকার থেকে আলোর স্বাধীনতা, ৭ দশক পর বিদ্যুৎ এল বাঁকুড়ার শবর গ্রামে
প্রতিদিন | ২৯ জুলাই ২০২৫
টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: অবহেলা আর অন্ধকার থেকে স্বাধীনতা। আলো বলতে ছিল কেরোসিনের কুপি। শনিবার স্বাধীনতার ৭ দশক পার করে পিছিয়ে পড়া বাঁকুড়া জেলার একটি শবর গ্রাম পেল বিদ্যুতের আলো। আগে বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লকের রাওতোড়া গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই নেমে আসত এক অন্য স্বাধীনতা—নিঃসঙ্গতা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা—সব প্রশ্নেই পিছিয়ে থাকা ১৫টি শবর পরিবারের জীবন যেন ছিল সভ্যতার প্রান্তের বাইরে একটা থেমে থাকা দ্বীপ। এখন প্রশ্ন উঠছেই—স্বাধীনতার এত বছর পরও এই গ্রাম কেন রইল আলো থেকে বঞ্চিত? এত সভ্যতা, এত উন্নয়ন, তবে কি এই গ্রাম জাতিগোষ্ঠী হওয়ার ‘মূল্য’ চুকিয়েছে?
এই দীর্ঘ অন্ধকারকে ছিন্ন করে এদিন সেই ঘরগুলিতে জ্বলে ওঠে বিদ্যুতের আলো। এর নেপথ্যে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বাঁকুড়ার আঞ্চলিক আধিকারিক সুমন্ত রায়। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা এই মানুষটি রাওতোড়ার অন্ধকারকে নিজের মনের আলোয় দেখেছিলেন। তাঁর কাছে এটি ছিল না কেবল একটি সরকারি প্রকল্প, এটি ছিল দায়িত্ববোধ। খাড়াই জঙ্গলঘেরা পথ, বর্ষার কাদামাটি, জনবসতির অনীহা, আর প্রশাসনিক স্তরের বাধা—সব কিছু পেরিয়ে সুমন্তবাবু তৈরি করেন একটি দল। তাঁরা রাত-দিন খেটে খুঁটি বসান, তার টানেন, ট্রান্সফর্মার স্থাপন করেন। স্বেচ্ছাসেবী বিধান মণ্ডল পাশে এসে দাঁড়ান। ওই এলাকার শিশুদের পাশে বই নিয়ে বসে তিনি বলছিলেন, “আলো আসবেই, পড়া থামিও না।”
অবশেষে এদিন সেই প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা আসে। জ্বলে ওঠে প্রথম আলো। কেউ হাততালি দেয়, কেউ চোখে জল এনে চুপ করে বসে থাকেন। ছোট ছোট মুখগুলো হাসে, যেন যুগের পর যুগের ক্লান্তি এক মুহূর্তেই ধুয়ে যায়। শিশুরা বলে, “এবার পড়তে ভালো লাগে”, “চোখে জ্বালা হয় না”, “আমি বড় হয়ে অফিসার হব।” তৃতীয় শ্রেণির রামকৃষ্ণ শবর, প্রথম শ্রেণির সুস্মিতা শবর, পঞ্চম শ্রেণির লক্ষ্মী শবর, তাদের মুখে এখন শুধুই স্বপ্নের গল্প। বৃদ্ধ গঙ্গা শবর বা গোলাপী শবরের চোখে ঝলমলে আনন্দ। সঙ্গে অবশ্য একটু অভিমানও, “এতদিন পরে কেন? আমরা কি মানুষ নই? কেউ কেন কথা শুনল না?” প্রশ্ন তাঁদের। তবে এতদিন পর হলেও বিদ্যুতের আলো পেয়ে কেরোসিনের কুপি সরিয়ে রেখে উদ্ভাসিত চোখে সবাই একে অপরের দিকেই চেয়ে। রাওতোড়ার বাসিন্দাদের কথায়, “আমরা আলো পেয়েছি, আমরা দেশবাসী, আমরা পিছিয়ে নেই আর। এই আলো জ্বলল আমাদের মনের ভিতরেও।”