• বিপজ্জনক ‘এআই ভয়েস ক্লোনিং’! নিখুঁত উচ্চারণে আপনজনের গলা নকল করে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে হ্যাকারেরা
    আনন্দবাজার | ৩০ জুলাই ২০২৫
  • আপনার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে আপনজনের নম্বর। ফোন তুলতেই অবিকল সেই গলাতেই কথা ভেসে আসবে ও পার থেকে। আপনিও না বুঝে উত্তর দিয়ে যাবেন। ভুল যখন ভাঙবে, দেখা যাবে আপনার ফোনের সব তথ্যই বেহাত হয়ে গিয়েছে। অথবা আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দিয়েছে হ্যাকারেরা। এত দিন ব্যাঙ্কের আধিকারিক বা সরকারি দফতরের উচ্চপদস্থ কর্তার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা চলছিল। কিন্তু এখন সে ধরন বদলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সুযোগ নিয়ে আর অপরিচিত মানুষজন নয়, কাছের ও ঘনিষ্ঠ লোকজনের গলা নকল করেই প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে সাইবার প্রতারকরেরা। এ দেশেরই নানা জায়গায় বিপদে পড়েছেন অনেকেই। তাই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ।

    প্রতারণার নতুন কৌশলের নাম ‘এআই ভয়েস ক্লোনিং’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে যা কোনও ব্যক্তির কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করতে পারে। এত নিখুঁত ভাবে কণ্ঠস্বর নকল করা হয় যে, বোঝার উপায় থাকে না। এর ফলে বাড়ির মহিলারা বা প্রবীণ সদস্যেরাই বেশি ঠকছেন।

    কী এই ভয়েস ক্লোনিং?

    এআই ভয়েস ক্লোনিং এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনও ব্যক্তির কণ্ঠস্বরের একটি ডিজিটাল প্রতিলিপি তৈরি করা হয়। তার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ধরনের সফট্‌অয়্যার। এখন মনে হতে পারে যে, সেই ব্যক্তির কণ্ঠস্বর কী ভাবে পাচ্ছে প্রতারকেরা। তার জন্য সমাজমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। ওই ব্যক্তির ফেসবুক বা হোয়াটস্‌অ্যাপ থেকে পরিচয় জোগাড় করা হচ্ছে। তার পর তাঁর কয়েক সেকেন্ডের একটি অডিও ক্লিপ জোগাড় করা হচ্ছে। হয় সেই ব্যক্তিকে ফোন করে তাঁর কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে নেওয়া হচ্ছে, অথবা সমাজমাধ্যমে সেই ব্যক্তির পোস্ট করা কোনও অডিয়ো বা ভিডিয়ো থেকে কণ্ঠস্বর জোগাড় করা হচ্ছে। এ বার সেটি ওই সফট্‌অয়্যারে ফেলে ‘ক্লোন’ বা প্রতিলিপি তৈরি করা হচ্ছে।

    এআই চালিত ওই সফট্‌অয়্যার শুধু কণ্ঠস্বরই নকল করে না, সেই ব্যক্তির বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, এমনকি শ্বাস নেওয়ার ধরন অবধি নকল করে ফেলছে। এর ফলে নকল করা কণ্ঠস্বর আসল না নকল, তা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ জানাচ্ছে, প্রতারকেরা এআই টুলের সাহায্যে কারও অডিয়ো বা ভিডিয়ো শুনে মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে কণ্ঠস্বর নকল করে নেওয়ার প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলেছে। ডিপফেকের মতো এখন ভয়েস ক্লোনিং নিয়েও তাই চিন্তা বাড়ছে।

    কী ভাবে চলছে প্রতারণা?

    প্রতারকরা প্রথমে আপনার বা আপনার প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর সংগ্রহ করছে। এটি বিভিন্ন উৎস থেকে হতে পারে— হোয়াট্‌সঅ্যাপের ভয়েস মেসেজ, নানা রকম রিল, ফেসবুকে আপলোড করা ভিডিয়ো ক্লিপ বা ইনস্টাগ্রাম অথবা ফোন কল। সংগৃহীত কণ্ঠস্বর এআই সফট্‌অয়্যার দিয়ে নকল করে আপনারই প্রিয়জন বা আত্মীয়স্বজনকে ফোন করে অবিকল আপনার গলায় বা আপনার কাছের কোনও মানুষের গলায় কথা বলে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করছে। এমন স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি করছে, যে যিনি শুনছেন তিনি ভাবতে বাধ্য যে আপনি বিপদে পড়েছেন। এর জন্য বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী বা খুবই নিকট আত্মীয়ের কণ্ঠস্বরই নকল করা হচ্ছে যাতে সহজেই ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়। এমন ফাঁদের ফলে আবেগে ভেসে অনেকেই বিপদে পড়েছেন।

    বাঁচার উপায় কী?

    ১) যদি আত্মীয় বা বন্ধুদের নাম করে কোনও ফোন আসে এবং অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলে, তা হলে সতর্ক হতে হবে। সেই ফোন যদি ঘন ঘন আসতে থাকে ও বারে বারে টাকা পাঠানোর কথা বলে, তা হলে আগে যাচাই করে নেবেন পরিস্থিতি তেমনই কি না।

    ২) পরিচিত কারও গলায় ফোন এলে ও সন্দেহজনক কথাবার্তা বললে সাবধান হবেন। সরাসরি টাকা পাঠানোর আগে এক বার ভিডিয়ো কল করে যাচাই করে নেবেন যে, তিনিই ফোনটি করেছিলেন কি না। হয়তো আপনার পরিচিত সেই ব্যক্তি এমন ভাবে কথাই বলেন না। তাই আবেগে ভাসার আগে সাবধান হতে হবে।

    ৩) এআই ক্লোন করা কণ্ঠস্বর অনেক সময় কিছুটা যান্ত্রিক শোনাতে পারে। অনেক সময় প্রতারকরা সংক্ষিপ্ত ভয়েস ক্লিপ ব্যবহার করে, ফলে খুব অল্প সময়ের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সে ক্ষেত্রে বার বার প্রশ্ন করতে থাকবেন। বেশ কিছু ক্ষণ কথাবার্তা চালালেই ধরা পড়ে যাবে। কারণ, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এআই দিতে পারবে না। তাই যদি দেখেন প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে বা ফোন কেটে দেওয়ার চেষ্টায় আছে, তা হলে বুঝতে হবে সেই কণ্ঠস্বরটি নকল।

    ৪) নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর, এটিএম কার্ড নম্বর, ইউপিআই পিন, ওটিপি এবং পাসওয়ার্ড, এই ধরনের কোনও তথ্য শেয়ার করবেন না। এমনকি, পরিচিত কারও গলা শুনলেও। যদি পরিচিত কণ্ঠস্বর এই সব তথ্য চায়, তা হলে ভিডিয়ো কল করার অনুরোধ করবেন। তা হলেই প্রতারণার চেষ্টা কি না, তা বোঝা যাবে।

    ৫) নিজের গলার আওয়াজ বা ভয়েস রেকর্ড সমাজমাধ্যমে আপলোড করা বন্ধ করুন। আপলোড করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। কারণ, প্রতারকেরা এই ধরনের অডিয়ো ক্লিপ সংগ্রহ করেই ভয়েস ক্লোনিং করছে।

    ৬) যদি আপনি কোনও এআই ভয়েস ক্লোনিং প্রতারণার শিকার হন বা এমন কোনও সন্দেহজনক কল পান, তা হলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে, যেমন সাইবার ক্রাইম পুলিশে রিপোর্ট করুন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)