একশো দিনেও দগদগে ক্ষত, দুই পরিবারকে তাড়া করছে পহেলগাম
আনন্দবাজার | ০১ আগস্ট ২০২৫
বেড়ানোর আনন্দ এক লহমায় বদলে গিয়েছিল স্বজন হারানোর দুঃস্বপ্নে। কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার সেই ঘটনার পরে তিন মাসেরও বেশি অতিক্রান্ত হলেও ভয়াবহ ওই দিনটি এখনও যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁদের। দিনকয়েক আগে সেই হামলায় যুক্ত তিন জঙ্গির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার খবর খানিকটা হলেও ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে। তবু, একটি প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও, হয়তো কোনও দিনই মিলবে না— কেন জঙ্গি হামলার মুখে পড়তে হল তাঁদের? ঘটনার ১০০ দিন বাদেও এই প্রশ্নই কুরে কুরে খাচ্ছে দু’টি পরিবারকে। গোটা ঘটনার সঙ্গে যে ভাবে রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছিল, তাতেও প্রবল বিরক্ত তাঁরা।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গি হানার খবর নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশ তথা বিশ্বকে। ওই উপত্যকায় বেড়াতে গিয়ে ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছিল জঙ্গিদের এলোপাথাড়ি গুলিতে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার বেহালার বাসিন্দা সমীর গুহ ও বিতান অধিকারী। চোখের সামনে স্বামীকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছিলেন সমীরের স্ত্রী শবরী গুহ। বৃহস্পতিবার বেহালার শখেরবাজারের বাড়িতে স্বামীর ছবির পাশে বসে সে দিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন শবরী। বললেন, ‘‘পুরুষদের ধরে ধরে গুলি করছিল জঙ্গিরা। সমীরকে একটাই গুলি করেছিল। ভেবেছিলাম, উনি বেঁচে যাবেন। কিন্তু রাতে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেহ শনাক্ত করায়। সে দিনের কথা ভোলা সম্ভব নয়। আমার মেয়েও ভুলতে পারেনি। শুধু মনে হয়, কেন যে গিয়েছিলাম!’’
শবরী জানালেন, সেই ঘটনার পরে তাঁদের মেয়ে ভাল রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় ফেরার পরে অনেক দিন ধরে তাঁর চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে ওই তরুণী কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তবে, পহেলগামের সেই ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই মেয়ে তাঁকে থামিয়ে দেন। আর কোনও দিন মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন কিনা, তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না শবরী। তাঁর কথায়, ‘‘পুজোর পরে আমাদের একসঙ্গে কেরলে যাওয়ার কথা ছিল। কাশ্মীরে বসেই ওর বাবা সব পরিকল্পনা সেরে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই মানুষটাই তো আর নেই, যাঁর উৎসাহ ছিল সব চেয়ে বেশি। এখন কার জন্য আর যাব!’’
সে দিনের ঘটনায় নিহত প্রত্যেককেই শহিদ ঘোষণা করা উচিত বলে দাবি করলেন শবরী। জানালেন, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী সমীর। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই চাকরি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন তিনি। যদিও কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও আশ্বাস মেলেনি। তবে, এ নিয়ে কোনও বিতর্কে যেতে চাইলেন না শবরী। শুধু বললেন, ‘‘সরকার নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কিছু ভেবে রেখেছে।’’
শোকের ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি বিতানের পরিবারেরও। বরং ছেলের স্মৃতি আঁকড়েই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচতে চান তাঁর অশীতিপর বাবা-মা। বর্তমানে বেহালার শখেরবাজারের বৈশালী পার্কে থাকছেন তাঁরা। এক আত্মীয় তাঁদের দেখাশোনা করেন। ছেলের স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতেই বাকি জীবনটুকু কাটাতে চান বলে জানালেন বিতানের মা মায়া অধিকারী। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা বাড়ি জুড়ে ওর কত স্মৃতি। ছেলে আমেরিকায় থাকলেও প্রতিদিন সকালে এখানকার সময় অনুযায়ী ভিডিয়ো কল করত। আজকাল সকালের দিকে কেউ ভিডিয়ো কল করলেই মনে হয়, এই বুঝি বুবুন (বিতানের ডাকনাম) ফোন করেছে।’’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে মা যখন একটানা এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন পাশে বসে বিতানের বৃদ্ধ বাবা বীরেশ্বর অধিকারী স্ত্রীকে যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। বীরেশ্বর বললেন, ‘‘এখন আমরা দু’জন পরস্পরকে সান্ত্বনা দিই। আর কী-ই বা করার আছে! আমাদের তো সব শেষ।’’
বিতানের স্ত্রী সোহিনীর সঙ্গেও তাঁদের নিয়মিত কথা হয় বলে জানালেন বীরেশ্বর। তবে, এ দিন অবশ্য ফোন করা হলেও বিতানের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বৌমার প্রসঙ্গ উঠতে বীরেশ্বর বললেন, ‘‘ওর শরীর ভাল নেই। তা ছাড়া, বলার আর কী-ই বা আছে? কেউ খোঁজ নিতে ফোন করলে শুধু কাঁদে।’’ তিনি নিজেকে কোনও মতে সামলে নিয়েছেন বলে দাবি করলেন বৃদ্ধ। বললেন, ‘‘ইস্পাত কারখানায় কাজ করতাম। ওদের ভাল রাখতে নিজের মনটাও ইস্পাতের মতো করে ফেলতে পারলে ভাল হত।’’