আসানসোলে সাইবার প্রতারণার তিনটি ঘটনার তদন্তে মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য। ব্যবসায় বিপুল লোকসান সামাল দিতে চীন, কম্বোডিয়া সহ অন্যান্য দেশের সাইবার অপরাধীদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত তৈরি করছেন বাংলার অসফল উদ্যোগপতিরা। বিশেষ করে কলকাতার ওইসব ব্যবসায়ীদের একটা অংশ প্রতারণার কাজে জড়াচ্ছেন। তাঁদের কর্পোরেট বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট মোটা টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন সাইবার প্রতারকদের। ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’, শেয়ার বাজারে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার টোপ সহ একাধিক প্রতারণার কর্মকাণ্ডে তাঁদের যোগসাজসের প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। সেই সূত্রে সম্প্রতি কলকাতার তিন ব্যর্থ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেন আসানসোল সাইবার ক্রাইম থানার পুলিস। আর তাঁদের জেরা করতেই উন্মোচিত হল সাইবার প্রতারণার একটা নতুন দিক।
তদন্ত এক: একটি সরকারি সংস্থার চিফ জেনারেল পদে দায়িত্ব সামলে অবসর নিয়েছিলেন বৃদ্ধ। থাকেন আসানসোলে। তাঁকে ভয় দেখিয়ে এক মাস ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ করে রাখা হয়। খুইয়ে ফেলেন তিন কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা। তদন্তে নেমে পুলিস জানতে পারে, মোট ১৬টি অ্যাকাউন্টে বৃদ্ধের টাকা গিয়েছে। তারমধ্যে একটি অ্যাকাউন্টে পড়ে ছিল ৭০ লক্ষ টাকা। দ্রুত সেই টাকা উদ্ধার করা হয়। সেই অ্যাকাউন্ট হোল্ডার কলকাতার বাসিন্দা। সেখানে শুরু হয় অভিযান। গ্রেপ্তার হন গল্ফগ্রিনের প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী। তাঁর কর্পোরেট অ্যাকাউন্টেই ঢুকেছিল প্রতারণার টাকা। তাঁর গাড়ির শোরুম ছিল। কারবারে বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি মেটাতে সাইবার প্রতারণার কাজে নেমেছেন।
তদন্ত দুই: শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করলেই রাতারাতি বৈভবের শিখরে। এই টোপ দেওয়া হয়েছিল আসানসোলের এক ব্যবসায়ীকে। বেশকিছু টাকা লগ্নি করার পরই তিনি বুঝতে পারেন প্রতারিত হচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিসের দ্বারস্থ হন তিনি। ততদিনে ১০ লক্ষ টাকা খুইয়ে ফেলেছেন। দ্রুত মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু। পুলিস দেখে, সাড়ে ছ’লক্ষ টাকা গিয়েছে কলকাতার বরানগরের এক বাসিন্দার অ্যাকাউন্টে। সেখানে গিয়ে চক্ষুচড়ক গাছ পুলিসের। তাঁর বিরাট ব্যবসা। এক্সপোর্ট, ইমপোর্টের কারবার। ঝকঝকে অফিস। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস দেখে তদন্তকারীরা আরও স্তম্ভিত। এমন হাই প্রোফাইল ব্যবসায়ীও সাইবার প্রতারণায় নাম লিখিয়েছেন! বর্তমানে ব্যবসা মন্দা চলছে। প্রচুর টাকা লোকসানও হয়েছে। সামাল দিতে প্রতারণার কাজে নাম লেখান বলে পুলিস জানতে পারে। সাইবার থানার পুলিস ওই ব্যক্তি সহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
তদন্ত তিন: সাইবার প্রতারণার ঘটনাটি ঘটে দুর্গাপুরে। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের নামে ২ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা খুইয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। এই মামলায় এখনও পর্যন্ত দশজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। তালিকায় রয়েছেন কলকাতার এক খ্যাতনামা প্রোমোটার। যিনি শহর ও শহরতলিতে বহু আবাসন গড়েছেন। প্রভাবশালীদের সঙ্গেও তাঁর দহরম-মহরম। সেই ব্যক্তির কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছিল সাইবার প্রতারকরা। এক্ষেত্রেও অভিযোগ, ফ্ল্যাট কেনাবেচা খানিক খারাপ হওয়ায় প্রতারকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি।
তিনটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এভাবে একাধিক ঘটনায় নাম জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যর্থ ব্যবসায়ীদের একাংশের। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন? সাইবার থানার অফিসারদের দাবি, আগে সাইবার প্রতারণা হতো কম টাকার। গরিব মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাঁর নথি নিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হতো। এখন ডিজিটাল অ্যারেস্ট কিংবা শেয়ারের লগ্নির নামে কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করা হচ্ছে। যা কোনও ভাবেই সাধারণ অ্যাকাউন্ট থেকে করা সম্ভব নয়। তাই প্রতারকদের নজর পড়েছে কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের উপর। যাঁদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে তাঁদেরকেই টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলছে। প্রতারকদের মাথারা বসে কম্বোডিয়া, চিন সহ অন্যান্য দেশে।