• খুনের পর দেওয়ালে গেঁথে দেওয়া দেহ কনস্টেবল ভাইয়ের নৃশংসতার শিকার বিশ্বনাথ
    বর্তমান | ০২ আগস্ট ২০২৫
  • ঘটনাবহুল জীবন। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমাদের চারপাশে কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। বহু ঘটনা হারিয়ে যায় মুহূর্তের ভিড়ে। কোনও ঘটনা উঠে আসে শিরোনাম হয়ে। আর তার মধ্যে কিছু রেখে যায় দাগ। রক্তের দাগ। এমনই সাড়া ফেলে দেওয়া কয়েকটি ঘটনা ফিরে দেখল বর্তমান। সোহম করের কলমে।শ্যামলা বর্ণ, ঠোঁটের উপর মাঝারি মাপের একটা গোঁফ, মাথা ভরা চুল। পরনে চেক শার্ট। দু’হাতে দঁড়ি বাঁধা অবস্থায় যেখানে সে দাঁড়িয়ে, তার ঠিক পিছনের দেওয়ালে মহাদেবের ধ্যানমগ্ন ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার। আর সামনের ঠাকুরের বেদির দেওয়াল ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা হচ্ছে। এই গোটা ঘটনা সে এক পুলিস অফিসারের কাঁধের পিছন থেকে উঁকি মেরে দেখছে। ডিসি ডিডি-১ গৌতম চক্রবর্তী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এহহ! বডিটা খালি গায়ে রেখেছিলি?’ উত্তর এল, ‘না তো! কালো প্যান্ট পরানো ছিল।’ উত্তরদাতা অলোকনাথ দত্ত। কলকাতা পুলিসের রিজার্ভ ফোর্সের কনস্টেবল। 

    ১৯৯৪ সালের ৬ মার্চ। রবিবার। ২সি, বিডন স্ট্রিটের দোতলার একটা ঘরের দেওয়াল খুঁড়তেই বেরিয়ে এসেছিল কঙ্কাল। সঙ্গে তীব্র পচা গন্ধ। শোনা যায়, সেই গন্ধে দুঁদে পুলিস আধিকারিকদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। সিগারেট খান না এমন আধিকারিকরা নাকি সেই ধোঁয়া-সেবন শুরু করেছিলেন। বড়তলা থানা কেস নম্বর ৬২/৯৪, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি/৩০২/২০১। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন ও তথ্যপ্রমাণ লোপাট। হত্যার নেপথ্যে সম্পত্তির লোভ, টাকা আর অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন। সম্পত্তির লোভে ভাই ভাইকে মারছে, খুন করছে, এই খবর প্রায়ই শিরোনামে আসে। কিন্তু প্রায় তিন দশক আগের এই ঘটনা একটু হলেও আলাদা। তোলপাড় ফেলা তো বটেই। দাদা বিশ্বনাথ দত্তকে মেরে সেই মৃতদেহ বাড়ির দেওয়াল খুঁড়ে রেখে, তার উপর প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছিল। যেন কিছুই হয়নি। খুনি? ভাই অলোকনাথ ছাড়াও তার স্ত্রী ও দুই শ্যালক। অলোকনাথ নিজেই পুলিস। খুব তাড়াতাড়ি স্বীকার করে নিয়েছিল খুনের কথা। কিন্তু পুলিসের ছক্কাপাঞ্জা তার জিনে। ভালো করেই জানত, মৃতদেহ এবং মার্ডার ওয়েপন না পাওয়া গেলে মামলা দাঁড়াবে না। ‘বডি কোথায়?’ প্রশ্ন এলেই সে শুরু করে দিত নানা প্রকারের ‘নাটক’। কখনও সে ভুলে যেত। কখনও কান্নায় ভেঙে পড়ত। কখনও মানসিক রোগীও হয়ে যেত। পুলিস হয়ে পুলিসি জেরায় সে বলেছিল, ‘সম্পত্তির ব্যাপারে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। ৯০ শতাংশ কাজ আমিই করেছি।’ বাকি দশ শতাংশ? রাখা ছিল তিন জনের জন্য। 

    সম্পত্তির ব্যাপারে যে অসুবিধার কথা অলোকনাথ বলেছিল, কী সেই অসুবিধা? কেমনভাবে সাতে-পাঁচে না থাকা বিশ্বনাথের দেহ পৈতৃক বাড়ির দেওয়ালেই পচে গেল? ফিরে যেতে হবে ঘটনার চার বছর আগে। বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা ছিলেন জগন্নাথ দত্ত। ১৯৯০ সালে ভদ্রলোক মারা যান। স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন বছর চারেক আগেই। কিন্তু উইল করে যেতে পারেননি। জগন্নাথের পাঁচ সন্তান। অমরনাথ, সমরনাথ, বিশ্বনাথ, অলোকনাথ ও এক মেয়ে অনুরাধা। বিডন স্ট্রিটের ওই বাড়ির দোতলায় থাকতেন অলোকনাথ। সঙ্গে স্ত্রী মমতা ও পাশের ঘরে শ্যালক শিবশঙ্কর ওরফে বাবু রায়। আর এক শ্যালক মৃণালের যাতায়াত লেগেই থাকত। তিনতলায় থাকতেন বিশ্বনাথ। অলোকনাথের বেশকিছু বদভ্যাস ছিল। জুয়া খেলা, নেশা, নারীসঙ্গ। ফলত, অর্থাভাব তার নিত্যসঙ্গী। এদিকে বিশ্বনাথ চুপচাপ, নিরীহ প্রকৃতির। তিনি ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ধর্মতলা শাখায় চাকরি করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পরই অলোক ঠিক করল, পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করতে হবে। কিন্তু সে জানত, ভাইবোনদের সম্মতি পাওয়া যাবে না। তাই বউ-শ্যালকদের নিয়ে চক্র বানিয়েই শুরু হল ‘অপারেশন’। প্রথমেই সে ছুটল এক উকিলের কাছে। উকিলকে বলল, তারা দুই ভাই আর এক বোন। এখানে বোন সেজেছিল অলোকনাথের স্ত্রী। আর এক ভাই হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল শ্যালককে। উকিলের কিন্তু সন্দেহ হল। নিজেই ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন তিনি। সার্চিংয়ের জন্য ছুটলেন পুরসভায়। আসল নথি দেখে চমকে উঠলেন সেই উকিল। বুঝলেন, কোনও গোলমাল আছে। নিজের উদ্যোগেই খবরের কাগজে একখানা বিজ্ঞাপন দিলেন তিনি— ‘২সি, বিডন স্ট্রিটের বাড়ি বিক্রি হবে। দুই অংশীদার ছাড়া আর কেউ থাকলে যোগাযোগ করুন।’

    এ আসলে বিজ্ঞাপন ছিল না। ওটাই বিশ্বনাথের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’। (চলবে)
  • Link to this news (বর্তমান)