• ‘সোমা বলছি’ থেকে ‘১৫০ গ্রাম বীর্য’! গুজব এবং মিথ্যাচারের কানাগলিই কি পথভ্রষ্ট করেছিল আরজি কর আন্দোলনকে?
    আনন্দবাজার | ০৮ আগস্ট ২০২৫
  • সোমা কে? চেনেন? সোমাকে চেনেন?

    একটু খেই ধরিয়ে দিতে হতে পারে। তবে অধিকাংশেরই মনে আছে। মনে থাকার মতোই ‘প্রভাবশালী’ হয়েছিল সেই অডিয়ো ক্লিপ। আরজি করে রাতের ডিউটিতে থাকা চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার দিনকয়েকের মধ্যেই হু-হু করে ছড়িয়ে পড়েছিল মোবাইলে মোবাইলে, ‘‘...আমি সোমা বলছি...!’’

    কে এই ‘সোমা’, যিনি নিজের পুরো পরিচয় দিয়েছিলেন ‘সোমা মুখার্জি’ বলে? আরজি কর হাসপাতালের ভিতরেরই একজন বলে নিজেকে দাবি করেছিলেন। সত্য পরিচয় না ভুয়ো? আরজি করের ভিতরে-বাইরে যাঁরা গত বছরের আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই আনন্দবাজার ডট কম জানতে চেয়েছিল— সোমাকে চেনেন?

    সকলেরই উত্তর, ‘‘না, চিনি না।’’ তালিকায় রয়েছেন অনিকেত মাহাতো (জুনিয়র ডাক্তার, যিনি আন্দোলন পর্বে আরজি করেই ছিলেন), আসফাকুল্লা নাইয়া (জুনিয়র ডাক্তার, তিনিও আন্দোলন পর্বে আরজি করে ছিলেন), রিমঝিম সিংহ (রাত দখলের প্রথম আহ্বায়ক), দেবাশিস হালদার (জুনিয়র ডাক্তার), রুমেলিকা কুমার (জুনিয়র ডাক্তার)।

    ধর্মতলার মঞ্চে অনশনকারীদের অন্যতম রুমেলিকা ‘সোমা বলছি’ শুনেই বললেন, ‘‘শুনেছিলাম, কিন্তু খুব একটা বিশ্বাস করিনি। কনস্পিরেসি মনে হয়েছিল।’’ দেবাশিসের কথায়, ‘‘সোমাকে চিনি না। ওই অডিয়ো ক্লিপের দুই থেকে তিন সেকেন্ড শুনলেই বোঝা যায় অবাস্তব।’’ আসফাকুল্লা জানালেন, কিছু ক্ষণেই যা বোঝার তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। তাই পুরোটা মন দিয়ে আর শোনার চেষ্টা করেননি। আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ মনে করেন, এ ধরনের কাণ্ডের পিছনে কাজ করে ‘অতিভক্তি’, যা ক্ষতিকর। আসফাকুল্লার কথায়, ‘‘ভক্তি আর অতিভক্তির মধ‍্যে পার্থক‍্য থাকে। এই ধরনের অডিয়ো কোনও বিষয়কে যে ভাবে অতি ভয়াবহ করার চেষ্টা করে, তাতে ক্ষতি হয়। আমরা সমর্থন করিনি এটা। অতিরঞ্জিত যে কোনও বিষয় থেকেই আমরা দূরে থেকেছি।’’ রুমেলিকাও মনে করেন, ‘‘গুজব আন্দোলনের ক্ষতি করেছে।’’

    লাভও কি হয়নি? রাত দখলের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমে আসা মানুষের সংখ্যায় কি ‘সোমা বলছি’-র মতো গুজবের কোনও ভূমিকা ছিল না? পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি রিমঝিম। স্বাধীনতার মধ্যরাতে রাস্তা দখলের ডাক তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন সমাজমাধ্যমে। রিমঝিমের কথায়, ‘‘কিছু মানুষ সেনসেশন পছন্দ করেন। কিয়দংশ তেমন হলেও আসলে মানুষ সে রাতে রাস্তায় নেমেছিলেন শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতেই।’’

    সোমার চরিত্রে কে?

    আরজি করের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্তের পাশাপাশি গুজব নিয়েও তদন্তে নামতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশকে। ডেকে জেরা বা সতর্কও করা হয়েছিল অনেককে। ধর্ষণ-হত্যার তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর সিবিআই-ও সমাজমাধ্যমে ঘুরতে থাকা প্রচুর অডিয়ো এবং ভিডিয়ো ক্লিপ সংগ্রহ করে। সংগ্রহ করা হয় অন্যান্য ধরনের পোস্টও। আদালতকে সিবিআই জানিয়েছে, পরীক্ষার জন্য সে সবই তুলে দেওয়া হয়েছিল ফরেন্সিক বিভাগের হাতে। কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও তার রিপোর্ট সিবিআইয়ের হাতে আসেনি।

    ‘সোমা’ কে, লালবাজার কি তা খুঁজে বার করতে পেরেছিল? আরজি কর-কাণ্ডের সময়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান ছিলেন মুরলীধর শর্মা। তাঁকে প্রশ্ন করায় জবাব মিলেছে, ‘‘আমি এখন ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার। আরজি করের তদন্তে আর নেই। এটা নিয়ে কিছু বলব না। বলা ঠিক হবে না।’’ আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেও এ সংক্রান্ত কোনও নির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। তবে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে গুজব সংক্রান্ত তদন্ত চলছে না।

    ‘সোমা’র শোনানো ‘সত্য ঘটনা’

    ‘সোমা’-রহস্যের সমাধান অধরাই রয়ে গিয়েছে। গুজব-তদন্তও থমকে। অথচ এক বছর আগে এই ভাইরাল অডিয়োই নাড়িয়ে দিয়েছিল বহু মানুষকে। বিনা প্রশ্নে জনতা বিশ্বাস করেছিল ‘সোমা’-র বলা ‘সত্যিকারের ঘটনা’! সেই নারীকণ্ঠে শোনা গিয়েছিল হত্যাকাণ্ডের ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ’! দাবি করা হয়েছিল:

    ১) পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা ঘটিয়েছিলেন নির্যাতিতারই সাত-আট জন সহ-চিকিৎসক। যাঁদের মধ্যে এক তরুণীও ছিলেন।

    ২) নির্যাতন করে খুনের আগে সকলে মিলে মদ্যপান করেছিলেন।

    ৩) নির্যাতিতার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ধর্ষণ করা হয়। সাহায্য করেন সেই তরুণী সহকর্মীও।

    ৪) শারীরিক অত্যাচারের পরে ধর্ষিতার দু’পা দু’দিকে টেনে ‘জরাসন্ধের মতো’ চিরে ফেলার চেষ্টা হয়।

    ৫) এর ফলে ভেঙে যায় ধর্ষিতার পেলভিক বোন। কলার বোনও ভাঙে অত্যাচারে। থেঁতলে যায় মাথা।

    ৬) ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে খুনের পর চারতলা থেকে নীচে নেমে ওই সাত-আট জন দেখতে পান, সঞ্জয় রায় (পরবর্তীতে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় একমাত্র দোষী সাব্যস্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত) বসে গ্রুপ ডি কর্মীদের সঙ্গে মদ্যপান করছেন। ওঁরা সঞ্জয়কে বলেন, ‘যা, সেমিনার রুমে তোর জন্য রেখে এসেছি। যা তুই এ বার গিয়ে কাজ করে দিয়ে আয়।’

    ৭) সঞ্জয় সেমিনার রুমে গিয়ে ‘ডেডবডিকে রেপ’ করেন।

    সেই সুর করে করে শিহরন জাগানো বর্ণনা বহু মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন। অনেকে হয়ত এখনও অবিশ্বাস করতে পারেন না। যদিও প্রথমে পুলিশ এবং পরে সিবিআইয়ের তদন্তের ফল এ সবের ধারকাছ দিয়েও যায়নি। এমন গুজব, এমন বানানো গল্প অবশ্য আরও ছিল—

    • ষড়-যন্ত্রী

    একটি ছোট্ট লেখা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজমাধ্যমে। বিশেষত হোয়াট্‌সঅ্যাপে। প্রথমেই নির্যাতিতার নাম ছিল। তার পর তাঁর ‘গণধর্ষক’ বা ‘সহযোগী’ বলে ছ’জনের তালিকা। এই ‘ষড়-যন্ত্রী’-দের প্রত্যেকেই আরজি করের সিনিয়র বা জুনিয়র চিকিৎসক। একজন মহিলা চিকিৎসকেরও নাম ছিল, যাঁকে উল্লেখ করা হয় নির্যাতিতার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ বলে। লেখা হয়, এই ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ই ‘‘ছল করে হল রুমে নিয়ে যায় এবং টানা ৪৫ মিনিট গ্যাং রেপের সময়... হাত চেপে ধরে রেখেছিল।’’ ঘটনাচক্রে, একটি বিশেষ সংখ্যালঘু ধর্মের চিকিৎসকের সংখ্যাধিক্য ছিল সেই বানানো তালিকায়, যা তখন নজরে পড়েছিল অনেকের।

    • গল্পের বীর্য

    প্রবীণ বামপন্থী সরকারি চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী সংবাদমাধ্যমের কাছে সটান দাবি করেন, আরজি করে নির্যাতিতার শরীরে ১৫০ গ্রাম বীর্য মিলেছে। গণধর্ষণের প্রমাণ হিসাবেই এই ‘তথ্য’ তিনি পেশ করেছিলেন। অনেক চিকিৎসক তখনই এই ‘তথ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘‘এই তথ্য ভিত্তিহীন। বীর্যের ক্ষেত্রে তরলের একক মিলিলিটার ব্যবহার হওয়ার কথা, গ্রাম নয়। একটি পুরুষ শরীর থেকে প্রতি বার বীর্যপাতে ১.৫-৫ মিলিলিটার বীর্য নিঃসরণ হতে পারে। অর্থাৎ, ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার বীর্য পেতে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন হতে হবে।’’ কিন্তু গল্পের গরু যখন গাছে ওঠে, যুক্তির সাধ্য কী তাকে ঠেকিয়ে রাখে!

    • ‘পলাতক’ ইন্টার্ন

    আরজি করের একাধিক ইন্টার্নের নাম এবং ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সমাজমাধ্যমে। দাবি করা হয়েছিল, তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং পলাতক। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের অধিকাংশ তখনও হস্টেলে রয়েছেন। কেউ কেউ নিজের বাড়িতে। কেউ কেউ আন্দোলনের মঞ্চেও। সে কথা তখন অবশ্য কেউ শুনতে চাননি! কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেশ কিছু নাম-ছবি ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে ‘পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে’ রব। বিচার-বিবেচনা না-করেই যে যেমন পেরেছিলেন, সেই ছবি-নাম শেয়ার করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। লাগাতার শেয়ার করেও গিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ইন্টার্নরাই শুধু নন, তাঁদের পরিবার-পরিজনেরাও তখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, সন্ত্রস্ত, বিভ্রান্ত। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের নেতৃত্বকে সেই গুজব থামাতে মুখ খুলতে হয়।

    • অ্যাসিড দিয়ে প্রমাণ সাফ

    আসল দোষীদের চিহ্ন মুছে ফেলতে আরজি করের সেই ঘটনাস্থল অ্যাসিড দিয়ে ধুয়ে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল, এমন দাবিও ছড়িয়েছিল নানা মাধ্যমে।

    • মহাপাত্র

    পদবি ‘মহাপাত্র’। এক লহমায় এক স্কুলশিক্ষকের পুত্রকে তৃণমূল বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রের পুত্র বানিয়ে তাঁর ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনিও আরজি করের একজন ইন্টার্ন।

    আরজি করের ঘটনা ঘিরে এমন গুজবের তালিকা কম নয়। ঘটনাচক্রে, এ সব রটনার জন্য প্রত্যেক পক্ষ আঙুল তোলেন প্রতিপক্ষের দিকে। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল যেমন প্রথম থেকেই নিশানা করেছে আন্দোলনকারীদের। এখনও তা-ই। দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল সাংসদ মালা রায়ের কথায়, ‘‘গুজব রটানো ছাড়া তৃণমূলের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার কোনও হাতিয়ার বিরোধীদের নেই। আরজি করের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছিল, সিবিআই তার বাইরে কিছু বার করতে পারেনি। ফলে জনমানসে প্ররোচনা তৈরি করতেই গুজব রটানো হয়েছিল।’’

    উল্টো অভিযোগ তুলছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অনিকেত বলছেন, ‘‘কে বা কারা গুজব ছড়িয়েছিল বলা মুশকিল। তবে সুপরিকল্পিত ভাবেই তা করা হয়েছিল। ‘আমি সোমা বলছি’ বা ‘বীর্যের তত্ত্ব’— কোনওটাই জুনিয়র ডাক্তারেরা বলেননি। মূল বিষয় থেকে নজর ঘোরাতেই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে গুজব ছড়ানো হয়েছিল।’’ কারা গুজব রটিয়েছেন, অনিকেত সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু না-বললেও দেবাশিস সরাসরি আঙুল তুলছেন শাসকদলের দিকে। তাঁর কথায়, ‘‘গুজবের আবরণ দিয়ে সত্যকে ঢাকার চেষ্টা হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে আরও যাঁরা জড়িত তাঁদেরও। যা সার্বিক ভাবে আন্দোলনের ক্ষতিই করেছে।’’

    রাজ্যের প্রাক্তন শাসকদল সিপিএম যেমন মনে করে, গুজব ছড়ানো নিয়ে কিছু বলার নৈতিক অধিকারই নেই বর্তমান শাসক তৃণমূলের। ২০১১ সালের পালাবদলের ক্ষেত্রে যাকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করেন অনেকে, সেই নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ তুলেছেন মহম্মদ সেলিম। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের কথায়, ‘‘নন্দীগ্রামের সময়ে আমরা দেখেছিলাম শিশুদের পা চিরে দিয়ে নদীতে ভাসানোর গুজবের রমরমা। জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডে দেখেছিলাম গুজবের আখ্যান। আরজি করের ক্ষেত্রেও মূল বিষয় থেকে নজর ঘোরাতেই নানা গুজব ছড়িয়েছিল।’’ সেলিমের আরও সংযোজন, ‘‘আরজি কর পর্বে গুজব যদি কেউ রটিয়ে থাকে, তা হলে প্রথম রটিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। যারা মেয়েটির বাড়িতে ফোন করে প্রথমে বলেছিল অসুস্থ, তার পরে বলেছিল সুইসাইড। তার তদন্তই হয়নি।’’

    সেলিমের জোট-বন্ধু তথা লোকসভায় কংগ্রেসের প্রাক্তন দলনেতা অধীর চৌধুরী অবশ্য গুজবে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী নন। আরজি কর-কাণ্ডের সময়কার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্য, ‘‘গুজব তো কতই রটে! পহেলগাঁওয়ের সময়েও তো কত গুজব রটল। কিন্তু তাতে মূল সত্য কখনও অসত্য হয়ে যায় না। মূল সত্য হল, আরজি করের মতো সরকারি হাসপাতালে এক জন তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। তার পরে সরকারের বিরুদ্ধে যে গণ আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তা ভাঙতে সরকার তার দাঁত-নখ বার করেছে। হুমকি দেওয়া থেকে বদলি করা— এই সবই ঘটেছে।’’

    বাংলায় কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে বামপন্থীদের ক্ষমতায় আসার ইতিহাসেও গুজব এবং মিথ্যাচারের ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন প্রাক্তন কংগ্রেসি এবং বর্তমানে তৃণমূলের সঙ্গে থাকা শিক্ষাবিদ নির্বেদ রায়। তাঁর কথায়, ‘‘এ রাজ্যে এক সময়ে সিপিএম রটিয়ে দিয়েছিল স্টিফেন হাউসের মালিক অতুল্য ঘোষ (একদা বঙ্গ কংগ্রেসের শীর্ষনেতা), প্রফুল্ল সেন (বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী)। যাঁদের এক জন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতেন ভাড়াবাড়িতে।’’ নির্বেদের মতে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সারা ভারতেই গুজব যুগযুগ ধরে চলে আসছে। আবার সারা দেশে ধর্ম নিয়ে গুজবের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যাঁরা গুজবকে ব্যবহার করেন না, ইতিহাসে তাঁরাই মহান হয়ে থাকেন। যেমন সম্রাট আকবর, সম্রাট অশোক।’’

    ছিল। আছে। থাকবেও?

    আরজি কর প্রথম নয়। ‘সোমা’ প্রথম নয়। রাজনৈতিক বা অন্য কোনও স্বার্থে গুজব, মিথ্যাচারের একটা ইতিহাস আছে। নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী গোয়েবল্‌স যেমন মনে করতেন, একটি মিথ্যাকে বার বার বলতে থাকলে, প্রচার করতে থাকলে তা বড় সংখ্যার মানুষ এক সময় ‘সত্য’ বলেই বিশ্বাস করবেন।

    মানুষকে জয় করার এই কৌশলের সঙ্গে একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল মহাত্মা গান্ধীর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং গান্ধী গবেষক তপন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মহাত্মা গান্ধী নিজে চিরকাল গুজবকে বর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করেই অনেক সময় গুজব রটেছে।’’ উদাহরণ দিয়ে প্রবীণ গান্ধী গবেষক বলছেন, ‘‘বিহারের চম্পারণে সত্যাগ্রহের সময়ে সেখানে কৃষকদের মধ্যে রটে গিয়েছিল, গান্ধী এসেছেন রামচন্দ্রের অবতার হয়ে। আবার উত্তরপ্রদেশের একটি আন্দোলনে তিনি না-গেলেও রটে গিয়েছিল, গঙ্গা থেকে আবির্ভাব হবে গান্ধীর। তিনিই সব সামলে দেবেন। দু’টি ক্ষেত্রেই গুজবের ফলে কৃষক আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর তাতে কোনও ভূমিকা ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে জলপাইগুড়িতে আদিবাসীরা গান্ধী টুপি পরে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেখানে রটে গিয়েছিল, গান্ধী টুপি পরলে ব্রিটিশ পুলিশ গুলি করলেও কিছু হবে না। এই ধরনের নানা গুজব রটত ‘গান্ধীবাবা’র নামে।’’

    যা দেখা গেল, গান্ধীর পথে তাঁর অনুগামী বা অনুরাগীরাও হাঁটেননি। শত্রুনাশের প্রয়োজনে মিথ্যাচার করা বা অর্ধসত্য বলা যেমন মহাভারতের কালেও ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছিল, এখনও তেমনই রয়েছে। সময় যত এগিয়েছে, গুজব ছড়ানোর ‘অস্ত্রশস্ত্র’ উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। কিন্তু গুজব সে কালেও ছিল, এ কালেও আছে। কিন্তু কেন? প্রেসিডেন্সির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রশান্ত রায় মনে করেন, ‘‘গুজবের সুযোগ তখনই ঘটে, যখন আস্থার খবরের অভাব হয়। গুজব এমন একটি অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। একাংশ গুজবের পরিকল্পনা করে, একাংশ ছড়ায় আর একাংশ চায় তা বিশ্বাস করতে।’’ প্রবীণ শিক্ষাবিদের উদাহরণ, ‘‘সিপাই বিদ্রোহের সময়ে গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজের গুজবের কথা তো সকলেরই জানা।’’ একই সঙ্গে জানালেন, তিনি মনে করেন গুজব অতীতেও রটেছে। এখনও রটে। এবং, ভবিষ্যতেও রটবে।

    অর্থাৎ, সুযোগ পেলে ‘সোমা’-রা ভবিষ্যতে আবার বলবে। বলেই যাবে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)