দু’টি বাড়ির মধ্যে দূরত্ব বড়জোর ২৫ কিলোমিটার, বছর ঘুরে গেল, আরজি কর-কাণ্ডে দুই পরিবারের জীবন কি বদলে গেল ৩৬৫ দিনে?
আনন্দবাজার | ০৮ আগস্ট ২০২৫
গলির গলি তস্যগলির মুখে অলস দুপুরে গল্পে মশগুল মহিলামহল। কিছুটা এগোলে দেওয়াল জুড়ে ঠাকুর-দেবতার ছবি। এক বছর আগে যেমন ছিল। দরজায় ঝুলছে লাল রঙের পর্দা। যেমন ছিল এক বছর আগে। কেবল রং খানিকটা ফিকে হয়েছে।
পর্দা সরিয়ে, দরজা ঠেলে ডাকায় তিনি সাড়া দিলেন। কিন্তু বাইরে এলেন না। অগত্যা ভিতরে ঢুকতে হল। জানতে চাইলাম, কেমন আছেন? জবাব এল, ‘‘লক্ষ্মী কখনও খারাপ থাকে? লক্ষ্মী খারাপ থাকলে বাকিরা ভাল থাকবে কী করে?’’ যিনি জবাব দিচ্ছিলেন, তিনি আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় একমাত্র দোষী সাব্যস্ত হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের বৃদ্ধা মা।
ভবানীপুরের ৫৫/বি, শম্ভুনাথ পন্ডিত স্ট্রিট। এক বছর আগে এই ঠিকানা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এ হল সঞ্জয়ের বাড়ি। বাহ্যিক ভাবে সে বাড়ির কোনও বদল হয়নি। এক বছর আগেও তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, তাঁর মানসিক স্থিতি একটু নড়বড়ে। গত এক বছরে সেই পরিস্থিতির বদল হয়েছে। বৃদ্ধার মানসিক ভারসাম্যহীনতা আরও বেড়েছে। নইলে কি সঞ্জয় সম্পর্কে প্রশ্ন করায় জবাব দেন, ‘‘ও তো ওর বাবার কাছে আছে!’’ অথচ সঞ্জয়ের বাবা প্রয়াত কয়েক বছর আগে। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল, দরজার পর্দার রঙের মতো সঞ্জয়ের মায়ের স্মৃতিও গত এক বছরে অনেকটা ফিকে হয়ে গিয়েছে।
ঘটনাচক্রে, অধুনা সঞ্জয়ের ঠিকানা এই বাড়ির অনতিদূরে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার। দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় জেল থেকেই হাই কোর্টে তাঁকে বেকসুর খালাস করার আর্জি জানিয়ে মামলা করেছেন। সেই মামলা গৃহীতও হয়েছে। শুনানিও শুরু হবে যথানিয়মে। কিন্তু সে সব নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই এলাকায়। সাংবাদিক দেখলে আর কৌতূহলী হয় না সঞ্জয়ের পাড়া। এ পাড়ার কোনও আগ্রহ নেই পড়শিকে নিয়েও। যেমন আগ্রহ দেখায়নি গলির মুখে গল্পগুজবে রত মহিলামহলও। ভাইয়ের বিষয়ে আগ্রহ নেই সঞ্জয়ের বোনেরও। ফোনে যোগাযোগ করায় শুধু বললেন, ‘‘ওর সঙ্গে অনেক দিনই সম্পর্ক ছিল না। ওর ব্যাপারে কিছু বলারও নেই। যা বলার আদালত বলবে।’’
সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ পাওয়ার পরে সঞ্জয় খুব একটা এই বাড়িতে থাকতেন না। বেশির ভাগ সময়েই থাকতেন ব্যারাকে। তবে যাতায়াত ছিল। ৫৫/বি, শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের ভাড়ার ঘরের এক কোণে রাখা জুতোর তাকে পুরুষদের পরার অনেকগুলি জুতো। সঞ্জয়ের জুতো। গত এক বছরে সে জুতোয় ধুলোর আস্তরণ জমেছে।
ভবানীপুরের এই ঠিকানা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগনার মফস্সলের অন্য বাড়িটিরও বাহ্যিক কোনও বদল হয়নি গত এক বছরে। এই বাড়িতে থাকেন নির্যাতিতা নিহত চিকিৎসকের বাবা-মা। গত বছর ৮-৯ অগস্টের রাতে আরজি করের সেমিনারকক্ষে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটেঠিল। কিন্তু হিন্দুরীতি অনুযায়ী মৃত্যুর বর্ষপূর্তি ধরা হয় তিথি অনুযায়ী। গত ৩০ জুলাই সেইমতো নির্যাতিতার বাবা গয়ায় গিয়ে কন্যার পিণ্ডদান করেছেন। কিন্তু সেই পিণ্ডদানের সঙ্গে তাঁদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। নির্যাতিতার বাবা যেমন বললেন, তাঁরা এখনও মনে করেন না সঞ্জয় একা দোষী। তাঁর কথায়, ‘‘আসল দোষীরা হাসপাতাল চত্বরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না!’’
তাঁরা মনে করেন, গত একটা বছরে অনেক কিছু হতে পারত। কিন্তু হয়নি। কী কী হয়নি? কী কী হতে পারত? নিহত চিকিৎসকের বাবার কথায়, ‘‘মেয়েটা থাকলে এত দিনে জুনিয়র থেকে সিনিয়র হয়ে যেত। এত দিনে এমডি হয়ে যেত মেয়েটার!’’
তা হলে কী কী হয়েছে? পরিপার্শ্বের বদল হয়েছে। পরিজন-পড়শিদের ক্রমে সরে যাওয়া হয়েছে। যে মৃত্যু টানা তিন মাস ধরে আলোড়িত করে রেখেছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে, এক বছরের মধ্যেই সেই আবহ মিলিয়ে গিয়েছে। তেমনই বক্তব্য নির্যাতিতার বাবার। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘আত্মীয়েরা কেউ আর বাড়তি খোঁজ রাখেন না। অনেকেই বদলে গিয়েছেন। ঝামেলা আর রাজনীতির চাপের মধ্যে কেউ ঢুকতে চান না। আমরাই তো চাপে আছি। ওঁরা কেন সেই চাপ নেবেন!’’ আরও বলেন, ‘‘প্রতিবেশীরাও বদলে গিয়েছেন। আর নিয়মিত যোগাযোগ করেন না। আসলে সকলের কাছেই নিজের স্বার্থ সবচেয়ে আগে। স্বাভাবিক।’’
গত একটা বছরে নির্যাতিতার পরিবারের ধারণায় আরও একটি বদল ঘটেছে। প্রথম থেকে তাঁদের অভিযোগ ছিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এখন সেখানে জুড়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারও। নির্যাতিতার বাবার কথায়, ‘‘আগে রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল। এখন সেই বন্ধনীতে জুড়ে গিয়েছে কেন্দ্রও। সিবিআই কোর্টে দাঁড়িয়ে কলকাতা পুলিশকে ক্লিনচিট দিচ্ছে! এর থেকে দুঃখের আর কী আছে!’’ কলকাতা পুলিশের উপর ‘অনাস্থা’ থেকেই সিবিআই তদন্তের আর্জি জানানো হয়েছিল আদালতে। তা-ই চেয়েছিল নির্যাতিতার পরিবারও। এক বছর পরে নির্যাতিতার বাবা বলছেন, ‘‘সিবিআই ঠিক করেছে, তারা বুঝবে না। বুঝলে গোটা প্রশাসনের কঙ্কাল প্রকাশ্যে চলে আসবে।’’
‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’— নাজিম হিকমতের লেখা কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আরজি করের ঘটনার অভিঘাতে যে শোক নাগরিক ক্রোধে পরিণত হয়েছিল, এক বছর পরে তার কিছু অবশিষ্ট নেই। নির্যাতিতার আত্মীয়-পড়শিরা সরে গিয়েছেন দূরে। সন্তানশোক বুকে নিয়ে নিজেদের মতো লড়াই জারি রাখার কথা বলছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। আর দোষী সঞ্জয়ের মায়ের বদল বা শোক কোনও কিছুই অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
স্মৃতি থেকে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যেতে গিয়েছে সমাজকে আলোড়িত করা ঘটনার দুই প্রান্তে থাকা দু’টি পরিবার। ঘুচে গিয়েছে ২৫ কিলোমিটারের ব্যবধান।