রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবসে ‘পদ্মফুলে ঠাকুরপুজো’ মালবীয়ের, সঙ্গে বাংলার মাহাত্ম্য কীর্তন! ক্ষত মেরামতের চেষ্টা, বলছে তৃণমূল
আনন্দবাজার | ০৮ আগস্ট ২০২৫
দিল্লি পুলিশের ‘বাংলাদেশি ভাষা’-র পক্ষে দাঁড়িয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। সাত দিনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণদিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষার বন্দনা করে দীর্ঘ পোস্ট বিজেপির আইটি সেলের সর্বভারতীয় প্রধান অমিত মালবীয়ের। তৃণমূলের খোঁচা, ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বিজেপি নেতা।
রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর অবকাশে মালবীয় সবিস্তারে লিখলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং ভারতের জাতীয় চেতনা গঠনে বাংলা ভাষার ভূমিকা সম্পর্কে। এমনকি সীমান্তের ওপারে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কতখানি, সে প্রসঙ্গও বাদ দিলেন না। তৃণমূলের কুণাল ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন যে, মালবীয় ফের ‘ভুল’ লিখেছেন। পাল্টা কটাক্ষে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বিঁধেছেন ফিরহাদকে।
মালবীয় শুক্রবার যে পোস্ট করেছেন, তা প্রায় দীর্ঘ নিবন্ধ। ৭২৬ শব্দে রবীন্দ্র-বন্দনা এবং বাংলা-বন্দনা করতে গিয়ে মালবীয় লিখেছেন, ‘‘আজ বাইশে শ্রাবণ, ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বহুবিদ্যাবিশারদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণবার্ষিকী।’’ কেন রবীন্দ্রনাথকে তিনি ‘বহুবিদ্যাবিশারদ’ বলছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে মালবীয় উল্লেখ করেছেন ‘কবি, লেখক, নাট্যকার, গীতিকার, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদ’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা। গত সোমবারের পোস্টে ‘জনগণমন’ সম্পর্কে মালবীয় লেখেন যে, প্রথমে একটি ‘ব্রাহ্মগীত’ হিসেবে গানটি লেখা হয়েছিল। শুক্রবার তিনি লিখেছেন, ‘‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) রচনা ‘জনগণমন’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তাঁকে প্রজন্মান্তর ধরে অগণিত হৃদয়ে অবিনশ্বর করে রেখেছে।’’
শুধু ভারতের জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই থেমে যাননি মালবীয়। যে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ সংক্রান্ত বিতর্কে নিজের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে গিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন, সেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথাও শুক্রবারের পোস্টে তিনি লিখেছেন। পাকিস্তানের কবল থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে বাংলাদেশ রবি ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে যে গ্রহণ করেছিল, সে কথা উল্লেখ করে মালবীয় লিখেছেন, ‘‘দেশে এবং বিদেশে বাংলা ভাষা আজ যে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, এই ভাষাকে সেই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়াটাই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন অবদান।’’ বাংলা এ দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ভাষাগোষ্ঠী এবং গোটা পৃথিবীর দশটি সবচেয়ে বড় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে এটি একটি বলে মালবীয় সমাজমাধ্যমে শুক্রবার লিখেছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ইংরেজিতে লেখা পোস্টেও বাংলা ভাষাকে মালবীয় ‘বাংলা ভাষা’ বলেই উল্লেখ করেছেন, ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ লেখেননি।
গত সোমবার মালবীয় যে পোস্ট করেছিলেন, তাতে বাংলাদেশে প্রচলিত কথ্য বাংলার বিভিন্ন রূপের বিষয়ে তাঁর একটি মন্তব্য বিতর্ক তৈরি করেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘বাংলা নামে এমন কোনও ভাষা নেই, যার মধ্যে এই সবক’টি কথ্য রূপ আসতে পারে।’’ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল তো বটেই, বিরোধী শিবিরে থাকা কংগ্রেস এবং বামেরাও মালবীয়ের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। বিজেপি নেতা বাংলা ভাষাকে অপমান করেছেন বলে তৃণমূল-বাম-কংগ্রেস গলা মিলিয়েছিল। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিদ্বজ্জন, অভিনেতারাও প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি খেলার মাঠেও টিফো দেখা গিয়েছিল ‘বাংলা ভাষার অবমাননা’র প্রতিবাদে।
বাংলাদেশের আর পশ্চিমবঙ্গের কথ্য বাংলা এই মুহূর্তে পরস্পরের চেয়ে কতটা আলাদা, তার ‘প্রমাণ’ গত কয়েক দিনে নানা মঞ্চ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা। এমনকি রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যও সাংবাদিক বৈঠকে বসে দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের ভাষা পশ্চিমবঙ্গের ভাষার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। মালবীয় শুক্রবার সরাসরি আর সে প্রসঙ্গে ঢোকেননি। তবে রবীন্দ্রনাথের যে বাংলা রচনার প্রথম স্তবককে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, সেই বাংলা যে ‘সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা’, তা মালবীয় নিজের পোস্টে উল্লেখ করেছেন।
পোস্টের শেষ অংশে মালবীয় লিখেছেন, ‘‘সংস্কৃত মহাকাব্যের প্রাচীনতম অনুবাদ থেকে শুরু করে উনবিংশ ও বিংশ শতকের বিপ্লবী রচনার মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলা সাহিত্য। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর মোদী সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে, যা ভারতীয় চেতনাকে আকার দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ভাষার গভীর অবদানের স্বীকৃতি।’’ তৃণমূলের নাম না-করে মালবীয় লিখেছেন, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে তুলে ধরছেন, তাঁরা ‘ভুয়ো বাংলাপ্রেমী’।
তৃণমূল মালবীয়ের এই পোস্ট নিয়ে খোঁচা দিতে শুরু করেছে। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘কিছুকাল ধরে বিজেপি এবং অমিত মালবীয় বাংলা ভাষাকে এবং বাংলাভাষীদের যে ভাবে অপমান করছেন, সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে গিয়ে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস নিয়ে পোস্ট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু না-জেনেই তাঁর সম্পর্কে পোস্ট করতে গিয়ে মালবীয় তালগোল পাকিয়েছেন।’’ কুণালের ব্যাখ্যা, ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ নোবেল পেয়েছিল বলে মালবীয় লিখেছেন, কিন্তু ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাননি, তার ইংরেজি সংস্করণ ‘সং অফারিংস’-এর জন্য পেয়েছিলেন। বাংলায় লেখা ‘গীতাঞ্জলি’ এবং ইংরেজিতে লেখা ‘সং অফারিংস’ নানা বৈশিষ্ট্যেই পরস্পরের থেকে আলাদা বলে কুণাল মন্তব্য করেছেন। কুণালের কথায়, ‘‘বাংলা ভাষা সম্পর্কে অমিত মালবীয় যা বলেছেন, তার জন্য সর্বাগ্রে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।’’
রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য পাল্টা কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলকে। তিনি বলেছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ এখন আর পার্থিব শরীর নিয়ে আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার বদলে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়ে গিয়েছি। ফিরহাদ হাকিম তো সে কথা বলেই দিয়েছেন। সুতরাং এটাই হচ্ছে বাইশে শ্রাবণ বাঙালির জন্য সবচেয়ে বড় পাওনা।’’ মালবীয়ের পোস্টকে ‘ক্ষতস্থানে প্রলেপ’ দেওয়ার চেষ্টা বলেও শমীক মানছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘অমিত মালবীয় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি বাংলায় কাজ করছেন। বাংলা আর রবীন্দ্রনাথ সমার্থক। সুতরাং প্রয়াণ দিবসে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানানো হবে, এটাই স্বাভাবিক।’’