• তিনি হারেননি, কিন্তু হেরে যাওয়া বন্ধুদের মুখ মনে পড়তেই মঞ্চে উঠে দিদিকে দরবার, আনন্দবাজার ডট কম-কে বললেন রাজশ্রী
    আনন্দবাজার | ০৮ আগস্ট ২০২৫
  • হাতের কাছে মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে বলে ফেলেন। বলে ফেলেন, কিছু একটা করুন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথা শুনেছেন। আশাও দিয়েছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের সামনে কী ভাবে বলে ফেললেন মনের কথা? আগে থেকে পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন? না কি মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে সোডার বোতলের মতো উপচে গিয়েছিল আবেগ! ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের সেই রাজশ্রী হাঁসদার সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার ডট কম।

    ছোট থেকে খেলাধুলো করতে ভালবাসেন রাজশ্রী। ফুটবলই যে খেলবেন, তা স্থির করেছিলেন গোপীবল্লভপুরের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই। একটা সময়ের পর ঠিক করেন, ফুটবল খেলাবেন। খেলা পরিচালনা করবেন। রাজশ্রী পেরেছেন। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, তিনি একা নন, জঙ্গলমহলে আরও অনেক মেয়ের তাঁরই মতো স্বপ্ন ছিল রেফারি হওয়ার। তাঁরা পারেননি। বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে সংবর্ধনার মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সময়েও রাজশ্রীর মনে ছিল ওই হেরে যাওয়া মেয়েদের কথা। গাঢ় নীল টিশার্ট আর জগার্স ট্রাউজ়ার পরা, চুল টেনে বাঁধা রাজশ্রী মুখে হাসি নিয়েই দিদিকে জানান, কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে ওই মেয়েরা রেফারি হতে পারছে না। নতুন মেয়েদের স্বপ্ন বাঁচাতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করার প্রয়োজন। নয়তো ওদের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।

    আগেভাগেই কি ঠিক করে নিয়েছিলেন, মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীকে জঙ্গলমহলের রেফারি হতে চাওয়া মেয়েদের জন্য কিছু করার অনুরোধ করবেন? বছর পঁচিশের রাজশ্রী বলেন, ‘‘না না! মঞ্চে উঠেই মনে হল, ওদের জন্য কিছু বলতে হবে। এই প্রথম নয়। এর আগেও আমি এই মেয়েদের কথা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’’ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভক্ত রাজশ্রী জানিয়েছেন, গোপীবল্লভপুরের উইমেনস রেফারি অ্যাকাডেমির মেয়েদের একটা করে চাকরির ব্যবস্থা না-হলে বাড়ির চাপে সবাইকেই বিয়ে করে ফেলতে হবে। রেফারি হওয়া হবে না।

    ২০১৭ সালে গোপীবল্লভপুরে শুরু হয়েছিল উইমেনস রেফারি অ্যাকাডেমি। রাজশ্রী জানালেন, তখন ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪০। অতিমারির সময়ে বছর দুয়েক বন্ধ ছিল প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তার পরে তা সরানো হয় বেলিয়াবেড়ায়। তত দিনে ছেড়ে দিয়েছে বহু কিশোরী। রাজশ্রী জানান, তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেয়েদের সংখ্যা বড়জোর ১৫। রাজশ্রীর কথায়, ‘‘পরিবারের লোকেরা বলেন, হাফ প্যান্ট পরে ছেলেদের খেলাবে! ও সব চলবে না। কী মিলবে এ সব করে?’’ রাজশ্রীর গলায় আক্ষেপ, ‘‘আমাদের জঙ্গলমহলে অনেক ভাল মেয়ে (খেলোয়াড়) ছিল জানেন! বিয়ে দিয়ে দিল ওদের।’’

    গোপীবল্লভপুরে শুরু হওয়া ওই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজশ্রী-সহ পাঁচ জন এখন জাতীয় স্তরের ম্যাচ খেলাচ্ছেন। বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে পুরুষ, মহিলাদের ফুটবল ম্যাচ খেলাচ্ছেন। তাঁর কি বাধা আসেনি পরিবারের থেকে? রাজশ্রী বললেন, ‘‘এসেছিল বাধা। আমাকেও বিয়ে দিতে চেয়েছিল বাবা-মা। ওদের বুঝিয়েছি। ওরা বুঝেছে। আমাকে সব রকম সাহায্য করে ওরা।’’ রাজশ্রীর বাবা দামা হাঁসদা গোপীবল্লভপুরে চাষাবাদের কাজ করেন। চার সন্তানের মধ্যে রাজশ্রী তৃতীয়। ২৫ বছরের মেয়ের পাশে থেকে বাবা সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। মেয়ের স্বপ্ন, জাতীয় স্তর ছাপিয়ে ফিফার আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলাবেন একদিন। দামারও এখন তা-ই স্বপ্ন।

    স্বপ্নপূরণের জন্য ছোট থেকে মাঠে-মাঠে ঘাম ঝরিয়ে গিয়েছেন রাজশ্রী। এখনও চলেছেন। ছোটবেলায় দৌড়োতেন। নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেছেন। এখন পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে শারীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করছেন। রুটিন এখনও বদলায়নি তাঁর। রোজ ভোরে উঠে শরীরচর্চা করেন। তার পরে কলেজ যান। কলেজ থেকে ফিরে যোগ দেন ডিউটিতে। ২০২১ সাল থেকে বেলিয়াবেড়া থানায় সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন তিনি। রোজ আট ঘণ্টা ডিউটি করতে হয় তাঁকে। এখন কলেজ ছুটি বলে সকালের ডিউটি করছেন। কখনও রাতের ডিউটিও করতে হয়। এমনিতে ছুটিছাটা থাকে না থানায়। তবে খেলাতে যাওয়ার সময়ে থানার কর্তাদের অনুমতি নিয়ে ছুটি নেন, জানালেন রাজশ্রী।

    চলতি বছরের মে মাসে জাতীয় স্তরের রেফারি হয়েছেন রাজশ্রী। খেলার মরসুমে এখন তাঁকে কখনও কলকাতা, কখনও আবার বিভিন্ন রাজ্যে যেতে হয়। কলকাতায় কন্যাশ্রী কাপ খেলানোর অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। রাজশ্রী জানালেন, খেলাতে গিয়ে অনেক সময়ে বড় বড় হোটেলে থাকেন। সে সব সময়ে মনে পড়ে যায় জঙ্গলমহলের সেই রেফারি হতে না-পারা মেয়েদের কথা। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় যাঁদের আর প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি। রাজশ্রীর কথায়, ‘‘কষ্ট হয়। অনেক ভাল খেলত ওরা। আমি পারলাম, ওরা পারল না।’’ ছোটবেলার বন্ধুদের জন্যও খারাপ লাগে রাজশ্রীর। তিনি বলেন, ‘‘অনেক বন্ধু পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। ওদের এখন বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। কিছু করে না আর।’’ এই খারাপ লাগা থেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ। আশ্বাস পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর। আশা, কিছু একটা হয়ে যাবে মেয়েগুলোর।

    এখন অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষণরত মেয়েদের বেলিয়াবেড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া করে রেখেছেন প্রশিক্ষক শুভঙ্কর খামরি। পেশায় শিক্ষক শুভঙ্কর নিজেই ওই মেয়েদের প্রশিক্ষণের খরচ দেন। সাহায্য করেন রাজশ্রী এবং আরও কয়েকজন। কিন্তু এ ভাবে কত দিন? অনেক মেয়েই পরিবারের চাপে প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছেড়ে দিচ্ছে বলে আক্ষেপ রাজশ্রীর। সেই মেয়েদের হয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে বৃহস্পতিবার অনুরোধ করেছেন তিনি। তাঁর মতো ওই মেয়েদেরও একটা কাজের ব্যবস্থা হলে পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া বন্ধ হবে। তা ছাড়া, শুধু রেফারি হয়েও পেট চালানো সম্ভব নয়। রাজশ্রীর কথায়, ‘‘৩০-৩২ বছর পর্যন্ত খেলানো যায়। তার পরে তো রোজগারের জন্য চাকরির দরকার হবেই! সেই কথা ভেবেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম।’’

    এই ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাঝেমধ্যে উদ্বিগ্ন হন রাজশ্রী। তখন কী করেন? সিনেমা দেখেন— ‘চক দে! ইন্ডিয়া’, ‘টুয়েলভথ্ ফেল’, ‘দঙ্গল’, ‘থ্রি ইডিয়টস’। অথবা নাচেন। অথবা রোনাল্ডো, সুনীল ছেত্রীর খেলা দেখেন। এগুলি অনুপ্রেরণা জোগায় ওঁকে। নিজের পাশাপাশি বাকিদের কথাও ভাবায় ওঁকে। সে কারণেই মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধের ‘সাহস’ পান! রাজশ্রীর স্পষ্ট কথা, ‘‘সাহসের কী আছে? বলেছি। আবার বলতে পারি।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)