• বাংলা ভাষার টানে দামোদরের চরে জাপানি বধূরা, হাতে একতারা, মুখে লালন-গীত
    বর্তমান | ০৯ আগস্ট ২০২৫
  • সুখেন্দু পাল  খণ্ডঘোষ

    ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’ উচ্চারণে কোনওরকম জড়তা নেই। বিশুদ্ধ বাংলা। নিখুঁত লয় মেনে সুর-ছন্দের চলন। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে লালন-গীত গাইছেন ম্যাকি কাজুমি, ফোকো জুয়া’রা। সবার হাতে একতারা। সকলেই জাপানি বধূ।   

    খণ্ডঘোষের দামোদরের পাড়। চারদিকে নির্জন, নিঃস্তবদ্ধতা। সেই নিঃস্তব্ধতা খান খান করে দিচ্ছে সুবেশা বিদেশিনীদের সুরেলা কণ্ঠের সুর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন নদের পাড়ে ঘুরতে আসা যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে স্থানীয়রা। টানা প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে জাপানি বধূরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আসছেন। থেকেছেন কখনও অজয়ের পাড়ে জয়দেবে। কখনও আবার দামোদরের চরে। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে আটপৌরেভাবে তাঁদের থাকা-খাওয়া। যাতে বাংলার সঙ্গে অন্তরের টান অনুভব করতে পারে। বাংলার এক বাউলশিল্পী বহু বছর আগে জাপানে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন। তাঁর গান শুনেই বাংলা ভাষার প্রতি জাপানি রমণীদের এই প্রীতি। সেই থেকে এদেশের আসার সিদ্ধান্ত তাঁদের। বেছে নেন বাংলার মাঠঘাট। 

    এদিন গান করার ফাঁকে ম্যাকি-ফোকোরা বলছিলেন, ‘বাংলা শুধু নিছকই ভাষা নয়। এর মধ্যে আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। প্রাণ খুলে এই ভাষায় গান গাওয়া যায়। বাংলার বাউলই বাঁচার রসদ জোগায়।’ ম্যাকির কথায়, ‘প্রথম দিকে বাংলায় কথা বলতে পারতাম না। খুব অসুবিধা হতো। এখন সবকিছু বুঝতে পারি। বলতে পারি। নিজের মতো ছন্দ করে বাংলা গানও গাইতে পারি। বাংলার মতো ভাষার বৈচিত্র অন্যত্র পাওয়া যায় না। বাউল গান নিয়েই আমরা বেশি চর্চা করি। প্রতিটি লাইনের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অর্থ রয়েছে। যা অন্য কোনও ভাষায় নেই।’ একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘জাপানে গিয়েও আমরা বাউল গান গাই। সেখানে যাঁরাই আমাদের গান শোনেন, তাঁরাই মুগ্ধ হয়ে যান। বাংলাতে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। অনেকে আসছেনও।’ 

    লালন-গানের সুর থামিয়ে আর এক জাপানি মহিলা বলছিলেন, ‘খণ্ডঘোষের আশ্রমে প্রায় ৩০ বছর ধরে আসছি। এখানে একবার যে এসেছেন, তিনি বারবার আসতে চাইবেন। আমাদের নিজস্ব বাউলের দল রয়েছে। এ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করি। বিদেশেও বাংলা ভাষার ডালি নিয়ে যাই। বিদেশিরাও বাংলা ভাষায় গান শুনতে চান।’ স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, খণ্ডঘোষে দামোদরের তীরে আশ্রম তৈরি করেছিলেন প্রায়াত বাউল সাধক সাধন দাস বৈরাগ্য। তিনি নিজে পাঁচ হাজারের বেশি গান লিখেছেন। তাঁর কাছেই বাউল শিক্ষা নিয়েছেন জাপানি মহিলারা। এই আশ্রামে চারজন জাপানি রয়েছেন। আরও অনেকে আসা-যাওয়া করেন। কয়েক দিন আগে এই আশ্রমে গিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাণী সম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘যাঁরা বলছেন বাংলা বলে ভাষা নেই, তাঁরা অজ্ঞ। তাঁদের একবার এই আশ্রম ঘুরে যাওয়া দরকার।  
  • Link to this news (বর্তমান)