• এই পুলিশ মারে না, কাউকে সে বকে না, বলে শুধু এ ঐ, মন দিয়ে পড়ো বই
    আজকাল | ০৯ আগস্ট ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: কারও বাবা রিকশাচালক, কারোর মা আবার গৃহ পরিচারিকা। কিন্তু তাঁদের চোখে একটাই আশা।সন্তান যেন দুধে ভাতে থাকে। তাঁদের জীবনের অন্ধকার যেন না লাগে সন্তানদের। কিন্তু সেই  অন্ধকার কাটানোর দিশা এঁদের ছিল না। এই আশার আলো উসকে দিয়েছে হাওড়া সিটি পুলিশের মহিলা থানা। প্রতিদিন বিকেল চারটে থেকে সন্ধে পর্যন্ত মহিলা থানার বারান্দায়  চলে পঠন-পাঠন। সেখানে পিছিয়ে পরা সেই পরিবারের সন্তানেরা আসে শিক্ষা লাভ করতে। সেখানে শিক্ষক 'পুলিশ দিদিরা'। প্রতিদিন নিজেদের সময় থেকে কিছুটা সময় বের করে শিশুদের পড়াচ্ছেন তাঁরা।  রামকৃষ্ণপুর ঘাট, তেলকল ঘাট, হাওড়া স্টেশন চত্বরে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছে এই 'পুলিশ দিদিরা'। শাস্তি  জেল, জরিমানা করে সংশোধন নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক দিশা দেখিয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তাদের নতুন পথের পথিক করে তুলেছে হাওড়া সিটি পুলিশ।  

    ২০২৪ সালের ১১ই মার্চ হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার প্রবীণ কুমার ত্রিপাঠীর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই প্রকল্প । যার পোশাকি নাম 'বারান্দায় রোদ্দুর'। মাত্র ২৫ জন শিশুকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই পথচলা।  মাত্র এক বছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে  ৫৪। যার মধ্যে ৫১ জনকে ইতিমধ্যেই স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হয়েছে।  প্রতিদিন  বিকেল চারটে থেকে শুরু হয় পঠনপাঠন। শুধুমাত্র রবিবার তাদের ছুটি। রামকৃষ্ণপুরের আশপাশের এলাকা, হাওড়া স্টেশনের  পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুরা নিয়মিত আসে এই পাঠশালায়। তাদের গায়ে থাকে লাল রঙের ইউনিফর্ম। সেখানে লেখা আছে 'বারান্দায় রোদ্দুর'।  অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের পড়াশোনার জন্য বই দেয়। উদ্দেশ্য একটাই, প্রত্যেক শিশুর জন্য শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করা। যাতে তাদের ভবিষ্যৎ রোদ্দুরের মতো উজ্জ্বল হয়। 

    রাস্তার ধারে থাকা যে সমস্ত শিশু স্কুলে যায় না বা স্কুলছুট বা যারা ভিক্ষাজীবী বা সংসর্গে পড়ে নেশায় আসক্ত হয়ে গিয়েছিল তাদেরই অনেককেই ধরে এনে থানায় পড়াশোনা শেখান পুলিশ দিদিরা। সমাজবিরোধীদের কাছে এই মহিলা পুলিশ কর্মীরা রীতিমতো 'আতঙ্ক' হলেও এই পড়ুয়াদের কাছে তাঁরা স্নেহময়ী। কারণ তাঁরা মনে করেন, শিক্ষার আলো পেলে এরা আর খারাপ পথে হাঁটবে না।  এখানে শুধু অ,আ, ক, খ শেখানোই নয়, নজর রাখা হয় পড়ুয়া শিশুদের শারীরিক যত্নের উপরেও। শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়মিত আসেন  চিকিৎসকরা।  পাশাপশি চলছে সংস্কৃতিচর্চাও।  করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেখানে শিশুদের উজ্জীবিত করতে তুলে ধরা হয় সমাজের বিভিন্ন সুন্দর দিকগুলি। 

    এ বিষয়ে পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,  এই শিশুরা যাতে পড়াশোনা করে তার ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের শিশুশ্রম থেকে বিরত করার মতো বিষয়গুলো যেমন থাকে তেমনি নাবালিকাদের ভালো স্পর্শ বা খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে অবহিত করাও হয়। যাতে তারা কোনোরকম অন্যায়ের শিকার না হয় সেই বিষয়ে তাদের সতর্ক করা হয়। এর পাশাপাশি শিশুরা যাতে অপরাধ জগতে না প্রবেশ করতে পারে সেই শিক্ষাও দেওয়া হয় তাদের।  মহিলা থানার বারান্দায় শিশুরা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কিনা তা মাঝে মাঝেই দেখতে আসছেন হাওড়ার পুলিশ কমিশনার প্রবীণ কুমার ত্রিপাঠী |

    বছরখানেক আগে কয়েকজন মাত্র শিশুকে মহিলা থানায় নিয়ে এসে পড়াশোনা শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল | সেই উদ্যোগই বর্তমানে নিয়মিত পাঠশালায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে শৃঙ্খলাবোধ। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটে বাজলেই স্কুলের মতো নিয়ম করে থানার বারান্দায় মেঝেতে এসে বইখাতা নিয়ে বসে পড়ছে তারা। কেউ যদি না আসে তাদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেন পুলিশ দিদিরা। 

    পড়াশোনার শেষে থানা থেকে রোজ রাতের খাবারও নিয়ে যাচ্ছে শিশুরা। শিশুদের নিয়মিত এই খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন হাওড়ার পুলিশ কমিশনার| নিয়ম করে রবিবার ছুটিও থাকছে। 

    পুলিশের এক আধিকারিক-এর কথায়, এই শিশুদের জীবন শিক্ষার আলোয় রোদ্দুরের মতো জ্বলজ্বল করুক । এটাই আমরা চাই। স্বার্থক হয়ে উঠুক বারান্দায় রোদ্দুর নামকরণ।
  • Link to this news (আজকাল)