• বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ বলার বিতর্কে বিজেপির সাংস্কৃতিক অজ্ঞতা ফাঁস...
    আজকাল | ০৯ আগস্ট ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দেওয়া এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য ঘিরে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন রাজ্যের মানুষ। ভাষা নিয়ে আবেগপ্রবণ বাঙালিদের মনে এই মন্তব্য শুধু আঘাতই করেনি, বরং বিজেপির দীর্ঘদিনের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ খোঁজার রাজনীতিকে সরাসরি ভাষা-পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তীব্র জাতিগত ক্ষোভ উসকে দিয়েছে।

    বিতর্কের সূত্রপাত এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য থেকে হলেও, তা বহুগুণ বেড়ে যায় বিজেপির জাতীয় আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্যের ব্যাখ্যা-প্রয়াসে। তিনি দাবি করেন, “বাংলা বলে কোনও ভাষাই নেই”—যা শুধু তথ্যমূলকভাবে ভুল নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে মারাত্মক অজ্ঞতার পরিচয়। ভাষাবিদদের মতে, বাংলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যার নানা আঞ্চলিক উপভাষা পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) উভয় অঞ্চলে বিস্তৃত।

    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর এমেরিটা সুপ্রিয়া চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন—বাংলার বিভিন্ন জেলার ভাষা আসলে বাংলা ভাষারই আঞ্চলিক রূপ। নদীয়ার শান্তিপুর উপভাষা থেকে কলকাতার মানক বাংলার বিকাশ ইতিহাসের এক দুর্ঘটনা মাত্র। অর্থাৎ ভাষা একটাই—বাংলা, আর আছে এর নানা উপভাষা।

    পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর উপভাষা থেকে মেদিনীপুরের ভাষা পর্যন্ত, বাংলার আঞ্চলিক রূপের মধ্যে উচ্চারণ, শব্দচয়ন, ধ্বনিগত পার্থক্য থাকলেও মূল ভাষা অভিন্ন। অথচ বিজেপি নেতৃত্ব এই ভাষাগত বৈচিত্র্যকে আলাদা ‘ভাষা’ বানিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে—যা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক ও সাংস্কৃতিকভাবে অবিবেচনাপ্রসূত। প্রশ্ন উঠছে—যদি বাংলা ‘বাংলাদেশি’ হয়, তবে কি পাঞ্জাবি ‘পাকিস্তানি’? সিন্ধি বা মুলতানি কি তবে পাকিস্তানের ভাষা?

    ভারতের বহু প্রদেশে, যেমন আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা বা অরুণাচল প্রদেশে, প্রচুর মানুষ বাংলা বলেন। তাঁদের উচ্চারণ ও শব্দপ্রয়োগ ভিন্ন হলেও, তা বাংলা ভাষারই অংশ। বিজেপি নেতৃত্ব যদি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করত, তবে আজকের এই ভাষা-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হত না।

    ভাষা নিয়ে বিজেপির এই অবস্থানকে অনেকেই বৃহত্তর ‘শুদ্ধিকরণ’ রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখছেন—যেখানে মুসলিম- মুঘল যুগের প্রভাব মুছে ফেলার নামে সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষায় বিভাজনরেখা টানা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে বাংলাকে আলাদা করার এই প্রচেষ্টা শুধু ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্বের অপমান নয়, বরং বাঙালি পরিচয়ের উপর সরাসরি আঘাত।

    বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এই ধরনের বক্তব্য সমাজে বিভাজন আরও গভীর করবে। এতে ভাষা নিয়ে আবেগী মানুষের মধ্যে একধরনের অবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জন্ম নেবে। বাঙালির কাছে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং পরিচয়, ইতিহাস ও স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে রাজনৈতিক অস্ত্র বানানো মানেই বহু প্রজন্মের ভাষা-গৌরবকে কলঙ্কিত করা।
  • Link to this news (আজকাল)