সেই রাত! সেই সময়! এক বছর পরে আরজি করের সেই অকুস্থল অভিযানে আনন্দবাজার ডট কম, কী কী দেখা-শোনা-জানা গেল?
আনন্দবাজার | ১০ আগস্ট ২০২৫
লিফ্টের কাছে পৌঁছোতেই বাধা! নীলচে পোশাক পরা এক নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এলেন। তাঁর পিছনে আর এক জন। দৃষ্টিতে সন্দেহ। একটু কড়া গলাতেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘কোথায় যাচ্ছেন?’’
বিনীত ভাবে জানালাম, একটু উপরে যাব। আবার প্রশ্ন, ‘‘কার্ড কোথায়?’’ কার্ড তো নেই! রোগীর সঙ্গে দেখা করার জন্য যে কার্ডের বন্দোবস্ত রয়েছে আরজি করে, সেটা ছাড়া এই কাকভোরেও জরুরি বিভাগে ঢুকতে দেবেন না নিরাপত্তারক্ষীরা? না, দেবেন না!
আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক এক বছর পরে। ঠিক সেই সময়ে।
দিন কয়েক আগে সম্পাদক যখন ঘরে ডেকে প্রথম এই অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলেছিলেন, তখন থেকেই উশখুশ করছিলাম। আনন্দবাজার ডট কম-এ বিগত কয়েক বছরের চাকরিজীবনে যা একাধিক বার হয়েছে। হাতে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট এলেই উত্তেজনা হয়। সঙ্গে চাপা উদ্বেগ— ঠিকমতো পারব তো? আরজি করের ঘটনার এক বছরে রাতসফরের অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েও তেমনই মনে হচ্ছিল। সম্পাদকের ঘরে দাঁড়িয়ে প্রথম মনে পড়েছিল এক বছর আগের অন্য একটা রাত আর আরজি কর হাসপাতালের ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি। সে বার আঁধার ভেদ করে জরুরি বিভাগের চারতলায় পৌঁছোতে পেরেছিলাম। এ বারও কি তার পুনরাবৃত্তি হবে? না কি আটকে যাব নিরাপত্তার বেড়াজালে? আরজি করের ঘটনার পর ঠিক সেই ৮-৯ অগস্টের রাত থেকে ভোররাতের সেই ঘটনাস্থল ঘুরে দেখতেই তো যাওয়া।
সময়ের অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বাইপাস ধরে কলকাতা রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে আরজি করে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পৌনে ২টো বেজে গেল। তবে তখন আরজি করে আমার কাজ নেই। নিরাপত্তাবেষ্টনীর দিকে নজর রাখতে রাখতেই চলে গেলাম শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের দিকে। সেখানে জুনিয়র চিকিৎসকদের ‘রাত দখল’ চলছে। আরজি করের ঘটনার বর্ষপূর্তিতে নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মশালমিছিল হয়ে গিয়েছে। এখন মাঝপথে পথনাটিকা। কয়েকটা চেনা মুখের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে আসল গন্তব্যের দিকে এগোলাম। সময় হয়ে এসেছে প্রায়।
রাত ৩টে বাজে। কিন্তু দোকানপাট খোলা। চারদিকে আলোয় আলো। কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকদের পাশাপাশি পুলিশও রয়েছে ছড়িয়েছিটিয়ে। যতটা ভেবেছিলাম, আরজি কর হাসপাতাল চত্বর তার চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট। প্রধান ফটকের পাশে ম্যাগি আর ডিম টোস্টের দোকানে তখনও থিকথিকে ভিড়। ফুটপাতের ভিড় পেরোতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। ঘড়ি বলছে ৩টে বেজে ৭ মিনিট। সময় মিলিয়ে আরও ১৩ মিনিট পরে আমার হাসপাতালের ভিতরে ঢোকার কথা। এক বছর আগে ঠিক যেমন ঢুকেছিলেন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষক-খুনি।
ফোনে সিবিআইয়ের চার্জশিটটা রয়েছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মাথায় ছেপে নিয়েছিলাম। কিন্তু ভিতরে ঢোকার আগে সেটা আরও একবার ঝালিয়ে নিলাম। কারণ, জানি ভিতরে ঢুকে স্নায়ু অনেক টানটান রাখতে হবে। পকেট থেকে ফোন বার করে বার বার দেখলেই ধরা পড়ব। চার্জশিট বলছে, ৯ অগস্ট ভোর ৩টে ২০ নাগাদ আরজি করে ঢুকেছিলেন সঞ্জয়। ৩টে ৩৪ মিনিটে ট্রমা কেয়ার সেন্টারে যান এবং একতলায় ওঠেন। সেখান বেরিয়ে আসেন ৩টে ৩৬ মিনিটে। ভোর ৪টে ৩ মিনিটে তিনি জরুরি বিভাগের চারতলায় একটি ওয়ার্ডে ঢোকেন। সাড়ে ৪টের পরে বেরিয়ে যান।
ওই আধ ঘণ্টা ধর্ষণ এবং খুনের ‘সম্ভাব্য’ সময়। সঞ্জয়ের সেই রাতের ১ ঘণ্টা ১২ মিনিটের সফর আমার অ্যাসাইনমেন্ট।
৩.২০ মিনিট
হাসপাতালে ঢুকে পড়েছি। চারদিকে পুলিশ। ট্রমা কেয়ার বিল্ডিংয়ের নীচে কয়েক জন সিআইএসএফ জওয়ান। পাশে অনেকে শুয়ে আছেন। বেশির ভাগই রোগীর আত্মীয়স্বজন। অঘোরে ঘুমোচ্ছেন তাঁরা। আরজি করের চেনা দৃশ্য। ঘুমের ঘোরে কারও কারও পোশাক এলোমেলো হয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, চেতলার যৌনপল্লি ঘুরে এসে আরজি করে ঢুকেছিলেন সঞ্জয়। মদ্যপ এবং নেশাগ্রস্ত ছিলেন। জরুরি বিভাগে ঢোকার আগে আর কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন? কী কী দেখেছিলেন? সেই রাতেও কি এ ভাবেই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিবারের লোকজন ঘুমোচ্ছিলেন অঘোরে?
৩.২৭ মিনিট
ট্রমা সেন্টার ছেড়ে বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে প্রসূতি বিভাগ এবং আইসিসিইউ বিল্ডিং। উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে অলস পায়ে হাঁটছিলাম জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের দিকে। এই রাস্তায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে। বেশ কয়েক জন মহিলা নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। একটা পুলিশের গাড়িও চোখে পড়ল। রাস্তার ধারে কয়েকটা বাইক সার দিয়ে দাঁড় করানো। ঝপ করে মনে পড়ল সঞ্জয়ের বাইকের কথা। সেই নীল-কালো বাইকের সামনে সাদা হরফে বড় বড় করে ‘পুলিশ’ লেখা থাকত। সেই রাতে কোথায় বাইক দাঁড় করিয়েছিলেন সঞ্জয়? বাইক রেখে এই রাস্তা দিয়েই কি হেঁটে গিয়েছিলেন কোনও বাধা ছাড়াই?
হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে ভিতরে নিজের পরিচয় গুলিয়ে যাচ্ছিল। এক-একবার মনে হচ্ছিল, আমিই কি আসলে সঞ্জয়? এক বছর আগের আততায়ীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলেছি। আবার কখনও মনে হচ্ছিল, আমি কি সেই তরুণী চিকিৎসক? রাতের ডিউটিতে বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে চারতলার সেমিনারকক্ষে এসেছিলেন যিনি। একটু বিশ্রামের তোড়জোড় করছেন। কল্পনাও করতে পারছেন না, তাঁর ঘাতক নীচে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে। কিছু পরেই জরুরি বিভাগের নিরাপত্তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে উপরে উঠে আসবে।
ভাবতে ভাবতেই ভিতরে একটা উচাটন শুরু হল। ট্রমা সেন্টারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা এলোমেলো লাগছিল।
৩.৩৪ মিনিট
ট্রমা সেন্টারের সামনে পৌঁছে সিআইএসএফ জওয়ানদের পাশ কাটিয়ে নির্বিবাদে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। আসার পথে একঝলক দেখে মনে হচ্ছিল, জরুরি বিভাগ আর প্রসূতি বিভাগের সামনে নিরাপত্তারক্ষী যেন আচম্বিতে বেড়ে গিয়েছে। কিছু ক্ষণ আগেও চারদিকে পুলিশ-সিআইএসএফ ছিল। কিন্তু সাড়ে ৩টের পর সংখ্যাটা যেন বেড়ে গেল। সেটা কি এই রাত বলে? পুলিশ, সিআইএসএফ এবং নিরাপত্তারক্ষীরা কি একটু বেশি সজাগ? কাউকে তো এক বারও ঘুমোতে বা ঢুলে পড়তে দেখলাম না! সকলের সর্বত্র সজাগ দৃষ্টি। এত ক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছি। ওঁরা খেয়াল করেছেন। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বলছেন না তো! এগুলো কি ঘটছে? না কি আমার অতি সজাগ মন আমায় এ সব ভাবাচ্ছে?
ট্রমা সেন্টারের লিফ্টে চড়ে একতলায় উঠলাম। অনেক রোগী। জরুরি বিভাগের রোগীদেরও এখন ট্রমা সেন্টারে নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে ভিড়টা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম। তার পরে লিফ্টেই নেমে এলাম আবার। মাথার চার্জশিট বলছে, এখানে মাত্র দু’মিনিট ছিলেন সঞ্জয়। আমার মিনিট চারেক লাগল।
৩.৩৮ মিনিট
আবার এলাম জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের সামনে। ইতিমধ্যে বারদুয়েক ঘুরে গিয়েছি। এখন সিআইএসএফের সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি। তাঁরা অবশ্য আমায় আটকালেন না। ভাবছিলাম, চারতলায় উঠতে পারব? ঢুকতে পারব এক বছর আগের সেই রাতের সেই ঘটনাস্থলে?
লিফ্টের কাছে পৌঁছোতেই বাধা পেয়ে সম্বিৎ ফিরল। সেই প্রথম নিরাপত্তারক্ষীর প্রশ্নের মুখে পড়লাম। যথেষ্ট কড়া গলা। এবং তিনি রোগীর সঙ্গে দেখা করার নির্দিষ্ট কার্ড ছাড়া উপরে যেতে দেবেন না। দিলেনও না! মনে হল, তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। সহকর্মী অঙ্গীরা টানা ফোনে ছিল আমার কানে। ওকেই প্রশ্ন করলাম, কার্ড কোথায়? বুঝতে পারছিলাম, এই প্রশ্ন সিলেবাসের বাইরে। অঙ্গীরা একটু ভেবলে গিয়েছে। কিন্তু আমাকে তো রোগীর পরিজনের ভানটা করতে হবে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম অগত্যা।
৩.৪৫ মিনিট
জরুরি বিভাগ ছেড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে প্রধান ফটকের দিকে এগোচ্ছিলাম। সামনে এখনও বড় করে মঞ্চ বাঁধা। নিহত তরুণীর মূর্তির ছবিতে মালা। উপরে বড় হরফে লেখা ‘বিচার চাই’। হাসপাতালের একাধিক দেওয়ালে ‘বিচার’ চেয়ে লেখা স্লোগানও আছে। কিন্তু মঞ্চ ফাঁকা। জনশূন্য। মনে হল, মালা দিয়ে হয়তো সকলে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে রাত দখলে গিয়েছেন।
মনে পড়ছিল এক বছর আগের ১৪ অগস্ট রাত দখলের কথা। ঘটনাচক্রে, সে দিনও ভোর ৩টের পর এই হাসপাতালেই ছিলাম। আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে একদল দুষ্কৃতী বেরিয়ে এই প্রধান ফটকে ব্যাপক ভাঙচুর করেছিল। ঘটনাস্থল তখনও টাটকা। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল পুলিশ। লাঠিসোঁটা নিয়ে কেউ উপরের ঘটনাস্থল পৌঁছে গিয়েছে কি না দেখতে একাই রওনা হয়েছিলাম। জরুরি বিভাগের সমস্ত আলো সে রাতে বন্ধ ছিল। সে সবের পরোয়া না করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাঝে মাঝে মোবাইলের ‘ফ্ল্যাশ’ একমাত্র আলোর রেখা। ভয় করছিল। কিন্তু ‘এক্সক্লুসিভ’-এর লোভ ভয়কে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
৪.০৩ মিনিট
গলায় ঝোলানো ব্লু-টুথ নেকব্যান্ড, হাতে হেলমেট দোলাতে দোলাতে সঞ্জয় এই সময়েই চারতলার করিডর দিয়ে সেমিনারকক্ষে ঢুকেছিলেন। আমি অবশ্য সেখানে যেতে পারিনি। বাইরেই বাধা পেয়েছি। ফিরে আসতে হয়েছে।
৪.৩২ মিনিট
ভোরের আলো ফুটছে। ধীরে ধীরে লোকজন বাড়তে শুরু করেছে হাসপাতাল চত্বরে। ঘুমন্তেরা উঠে পড়েছেন। চায়ের দোকানে ভিড়। আরও কিছু দোকান খুলছে।
৪.৩৪ মিনিট
আলো ফুটে গিয়েছে। খিদে-তেষ্টার বোধ ফিরে এসেছে। জরুরি বিভাগের ক্যান্টিন থেকে একটা কেক কিনলাম। তার পরে অফিসে জানিয়ে আরজি কর ছেড়ে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বেরোনোর মুখে চোখে পড়ল লাল রঙের গাড়িটা। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই গাড়ি সাধারণত ব্যবহার করেন থানার ওসি বা সহকারী ওসি। গাড়িটা এত ক্ষণ ট্রমা কেয়ারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমার গাড়ির সঙ্গেই সেই লাল গাড়িও আরজি কর ছেড়ে গেল।
মনে হল, এক বছর পরের ৮-৯ অগস্টের রাতের দিকে কি পুলিশেরও বিশেষ নজর ছিল? মনে হল, এক বছর আগে যদি এই নজরদারিটা থাকত! এক বছর আগের রাতে যদি জরুরি বিভাগে ঢোকার মুখে নিরাপত্তীরক্ষীর কড়া প্রশ্নের মুখে পড়তেন ‘দাপুটে সিভিক’ সঞ্জয় রায়!