প্রাথমিক থেকে জয়েন্ট এন্ট্রান্স, শিক্ষার সব স্তরে ‘ধাক্কা’! শিক্ষা থেকে ‘শিক্ষা’ না নিয়ে বারবার বিপাকে পড়ছে শাসক তৃণমূল
আনন্দবাজার | ১৪ আগস্ট ২০২৫
চিত্র ১: ২০১৪ সালে প্রাথমিকের টেটে নিয়োগ হওয়া ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের মামলা আদালতে ঝুলে রয়েছে।
চিত্র ২: ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়া ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি ইতিমধ্যেই আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়েছে।
চিত্র ৩: ২০১৭ সালের প্রাথমিক টেটের নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রশ্ন ভুল’ সংক্রান্ত মামলার জটিলতা কাটেনি।
চিত্র ৪: ওবিসি তালিকা নিয়ে মামলার কারণে থমকে রয়েছে কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে কলেজে ভর্তি। একই কারণে রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলও প্রকাশিত হয়নি।
এই চারটি চিত্র পাশাপাশি রাখলে স্পষ্ট যে, শিক্ষার ‘ভিত’ প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা, জয়েন্ট এন্ট্রান্স— সর্বত্র রাজ্য সরকার তথা শাসকদলের জন্য বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে। বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরে যে সমস্ত বিষয়ে রাজ্য সরকার বারবার অস্বস্তি এবং বিড়ম্বনায় পড়েছে, তার অন্যতম হল শিক্ষা। সেই সরকারি এবং প্রশাসনিক স্তরে অস্বস্তির পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক অস্বস্তিও। যার ভুক্তভোগী শাসক তৃণমূল।
কেন শিক্ষাক্ষেত্রই লাগাতার ‘ধাক্কা’ খাচ্ছে? প্রশাসনিক স্তরেই গলদ? না কি রাজনৈতিক ত্রুটিও রয়েছে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, ‘‘আদালতের একাংশের অসহযোগিতা রয়েছে। বিচারপতির দায়িত্ব ছেড়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপি-তে যোগদানেই তা স্পষ্ট। তবে আমরা (রাজ্য সরকার) নিয়োগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। এখনও কিছু মামলার জটিলতা রয়েছে। তা কাটিয়ে যত তাড়াতাড়ি নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করা যায় তা দেখছি।’’ তবে নির্দিষ্ট ভাবে চাকরি বাতিল বা ওবিসি মামলার জন্য জয়েন্টের ফলপ্রকাশ আটকে থাকা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কারণ, সেগুলি ‘বিচারাধীন বিষয়’।
ব্রাত্য আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ব্যাখ্যা দিলেও ‘শিক্ষায় ধাক্কা’ নিয়ে শাসকদলের অন্দরে নানা ব্যাখ্যা রয়েছে।
‘কাঠামোয় সিপিএম’
তৃণমূলের অনেকেই মনে করেন, বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের যে ‘আধিপত্য’ কায়েম হয়েছিল, তৃণমূল সরকারে এসে তার খোলনলচে বদলাতে পারেনি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘একটা ব্যবস্থায় যদি বিরোধীদলের লোকজন জাঁকিয়ে বসে থাকেন, সেই ব্যবস্থা ঠোক্কর খাবেই। যেমনটা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়।’’ এই প্রশ্নেই শাসকদলের আলোচনায় উঠে আসছে বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক উপাচার্যের উদাহরণ। তৃণমূলের এক বিধায়কের কথায়, ‘‘উনি ছিলেন সিপিএমের জমানায় শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তাঁকে আমাদের সরকার এসে সরায়নি। বরং তোয়াজ করেছে।’’
তৃণমূলের এই অংশ মনে করে, দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে প্রক্রিয়াগত ত্রুটির নেপথ্যে রয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত থাকা সিপিএমের লোকজন। যদিও এর পক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনও শাসকদলের তরফে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। বস্তুত, শাসকশিবিরের অনেকে মনে করেন, এটি আসলে সমস্যার ‘অতি সরলীকরণ’। গত জমানার উপর দোষ চাপিয়ে বল নিজেদের কোর্ট থেকে অন্যত্র ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা। কেন সিপিএমের লোকেদের ‘সিস্টেম’ থেকে সরাতে পারল না তৃণমূল? অভিজ্ঞদের অনেকের বক্তব্য, শিক্ষার বিষয়ে বোঝার মতো বামেদের যত লোক ছিল, তৃণমূলের তা ছিল না। সংগঠনের সঙ্গে সরকারের সমন্বয়ের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বাম জমানায় শিক্ষায় ‘অনিলায়ন’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ছিল। বিরোধীরা আঙুল তুলত। অভিযোগ উঠত, তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসই পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। অনিল জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি শুধু সংগঠনই করতেন। অর্থাৎ, শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যে সাংগঠনিক সমন্বয় তৈরি করতে পেরেছিল সিপিএম, তৃণমূল তা পারেনি। শাসকদলের এক নেতার ব্যাখ্যায়, ‘‘শিক্ষায় আমরা শিক্ষানবিশই থেকে গিয়েছি!’’
পার্থ ‘ব্যর্থ’ চট্টোপাধ্যায়
এই কাঠামোতেই সাত বছর শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিন বছর হয়ে গেল যিনি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলে। এখন যাঁকে তৃণমূলের অনেকে ‘ব্যর্থ চট্টোপাধ্যায়’ বলে অভিহিত করেন। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সরকারের গোড়া থেকে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য। ২০১৪ সালে ব্রাত্যকে সরিয়ে সেই দফতরে পার্থকে আনা হয়েছিল। ঘটনাক্রম বলছে, নিয়োগে যা অনিয়ম হয়েছে, অন্তত এখনও পর্যন্ত যে যে অভিযোগ উঠেছে, তার সবটাই পার্থের আমলের। ২০২১ সালে ফের পার্থের হাত থেকে নিয়ে শিক্ষা দফতরে ফেরানো হয় ব্রাত্যকে।
টাকা দিয়ে চাকরি, ফাঁকা ওএমআর শিট, তালিকায় গরমিল ইত্যাদি দেখে আদালত চুরির বিষয়ে বারংবার ভর্ৎসনা করেছে রাজ্যকে। অনিয়মের যে পদ্ধতি পার্থবাহিনী কায়েম করেছিল, তা যে পাকাপোক্ত ছিল না, তা-ও মানেন শাসকদলের অনেকে। অনেকের বক্তব্য, অনিয়ম করতে গেলেও একটা শৃঙ্খলা লাগে। সেটা সিপিএমের ছিল। কিন্তু তৃণমূল সেটা করতে পারেনি। আরও স্পষ্ট করে বললে, পার্থ তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার মাসুল গুনতে হচ্ছে তৃণমূলকে। তবে একই সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, পার্থ এখন কারাবন্দি বলে তাঁকে সবচেয়ে বড় ‘খলনায়ক’ বলে চিহ্নিত করা তুলনায় সহজ হয়ে গিয়েছে।
কয়লা, বালি বা গরুপাচারের মতো বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে। সে সব মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তলব পেয়ে নেতা-মন্ত্রীদের হাজিরা দিতে হয়েছে। গরুপাচার মামলায় জেল খেটে আপাতত জামিনে রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনিও আপাতত জামিনে। তার আগে চিটফান্ড মামলায় তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতার হওয়াও দেখেছে বাংলার রাজনীতি। কিন্তু শিক্ষার মতো ‘ছবি’ অন্য কোনও ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আসেনি। যার অন্যতম, পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাট থেকে নগদের পাহাড় উদ্ধার।
সাংগঠনিক দেখভালের অভাব
মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, সিপিএম জমানায় দলের সর্বক্ষণের কর্মী (হোলটাইমার) বা নেতাদের স্ত্রী-রা সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন নিয়ম ভেঙে। সে অভিযোগ যে একেবারে ‘ভিত্তিহীন’ নয়, তা-ও মোটামুটি সর্বজনবিদিত। কিন্তু সেই অভিযোগ রাজনৈতিক স্তরে মৌখিক ভাবেই থেকে গিয়েছে। ‘প্রামাণ্য’ কোনও নথি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে পারেনি শাসকদল। এই প্রশ্নেই উঠে আসছে সাংগঠনিক বিষয়টি। সিপিএম জমানায় যা-ই হত, তা দলীয় ভাবে সিদ্ধান্ত করে সরকারি স্তরে ‘প্রক্রিয়া’ বজায় রেখে করা হত। এসএসসি তৈরি হওয়ার আগে স্কুল পরিচালন কমিটিগুলিই শিক্ষক নিয়োগ করত। সেখানে সিপিএমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু একটা মোড়কও থাকত। কাকে চাকরি দেওয়া হবে, তা পূর্বনির্ধারিত থাকলেও নিয়মমাফিক ১০ জনের ইন্টারভিউ নেওয়া হত। তার পরে নিয়োগ হত। সংগঠনের সঙ্গে প্রশাসনের সমন্বয় ছিল পোক্ত। তৃণমূলে কখনও সে সব দেখা যায়নি। দলের এক অভিজ্ঞ নেতার কথায়, ‘‘কাঁচা কাজ হয়েছে।’’
কারণ, সিপিএম ‘পাকা’ কাজ করেছিল। যে কারণে তৃণমূল বাম জমানার নিয়োগ নিয়ে মৌখিক অভিযোগ করলেও কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কারণ, সিপিএমের সময়ে ‘প্রক্রিয়াগত’ কোনও ত্রুটি পাওয়া মুশকিল। যেহেতু দলের সঙ্গে প্রশাসনিক স্তরে সমন্বয় ছিল। তৃণমূলে সেই ‘বাঁধুনি’ নেই। ছিলও না।
রাজনৈতিক মহলের অনেকে বাম জমানার সঙ্গে তৃণমূল জমানার নিয়োগে মৌলিক একটি পার্থক্য দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, বাম শাসনের সময়ে দলের লোকেদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছিল। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। যাকে অনেকে ‘চাকরি বিক্রি’ বলে অভিহিত করছেন। গনি খান চৌধুরী রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মালদহের বহু লোক রেলে চাকরি পেয়েছিলেন। কথিত আছে, স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা সিগারেটের প্যাকেটে কারও নাম গনির কাছে সুপারিশ করলেও সেই চাকরি পাকা ছিল। কিন্তু সেখানেও ‘প্রক্রিয়া’ সঠিক রেখেই নিয়োগ করা হয়েছিল। যা করেছিল রেলবোর্ড।
জয়েন্ট জট
এ হেন বিড়ম্বনার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে ওবিসি তালিকা নিয়ে আইনি জটের কারণে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফলপ্রকাশ না-হওয়া এবং কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে কলেজে ভর্তি থমকে থাকা। সর্বভারতীয় জয়েন্টের ফলপ্রকাশ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের মতো উদ্বেগে অভিভাবকেরাও। যা তৃণমূলের সমর্থকদের মধ্যেও সরকার সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ প্রভাব তৈরি করছে। দক্ষিণ কলকাতার একটি ওয়ার্ডের পরিচিত তৃণমূল নেতার পুত্র সর্বভারতীয় জয়েন্টে সুযোগ পেয়েছেন ভিন্রাজ্যের একটি সরকারি কলেজে। ওই নেতার কথায়, ‘‘আমি চেয়েছিলাম ছেলেকে কলকাতা বা এ রাজ্যে পড়াতে। কিন্তু যা পরিস্থিতি, তাতে ছেলেকে বাইরে পাঠানো ছাড়া কোনও উপায় নেই।’’ আদালতের জটিলতা, আইনি দীর্ঘসূত্রিতার সঙ্গেই তিনি কাঠগড়ায় তুলছেন সরকারের ভূমিকাকেও। জয়েন্ট দেওয়া স্পর্শা সেনগুপ্ত যেমন বলছেন, ‘‘দু’মাস হয়ে গেলেও ফলপ্রকাশ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রছাত্রীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে। কবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তারও সদুত্তর নেই।’’
যে ভাবে নতুন ওবিসি তালিকা রাজ্য সরকার তৈরি করেছে, তাকে অনেকেই সংখ্যালঘুদের মন জয়ের কৌশল হিসাবে অভিহিত করছেন। তবে কলেজে ভর্তি আটকে থাকা বা জয়েন্টের ফল প্রকাশ না-হওয়ায় ভিন্ন উদ্বেগও কাজ করছে শাসকদলের একাংশের মধ্যে— যাঁরা এ বার কলেজে ভর্তি হবেন বা জয়েন্ট দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই সদ্য ১৮ পেরিয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁরা নতুন ভোটার হবেন। যাঁদের প্রথম ভোট হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচন। তাতে এঁদের কী প্রভাব পড়বে বা কতখানি পড়বে, তা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যেই অনেকে সন্দিহান। তাঁদের বক্তব্য, শিক্ষাই ‘শিক্ষা’ দেবে না তো?