• সূর্যের আলোয় হোমাগ্নি, দেবীর অবস্থান পশ্চিমে, কাঁথির কিশোরনগরের দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব আর কী?
    প্রতিদিন | ১৪ আগস্ট ২০২৫
  • রঞ্জন মহাপাত্র, কাঁথি: চারপাশে শারদ আবহ। গ্রামবাংলায় কাশফুলের দেখা পাওয়া যাক বা নাই যাক, বাঁশ-দড়ি নিয়ে মণ্ডপসজ্জার প্রস্তুতি বিলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তবে এ সময় অবশ্য বনেদি বাড়ির পুজোগুলোর তেমন ব্যস্ততা নেই। বরং এই আবহে সেসব প্রাচীন পুজোর ইতিহাস একবার ঝালিয়ে নেন পরিবারের সদস্যরা। কাঁথির কিশোরনগরের দুর্গাপুজো তেমনই। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন কিশোরনগর গড়ের রাজা রাম রায়ের পুজো। এখন তার জৌলুস হারিয়েছে, কিন্তু ইতিহাসের ঐতিহ্য অটুট।

    কিশোরনগরের এই দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজোর সময় মহিষ বলিপ্রথা প্রচলন ছিল। আড়াইশো বছর ধরে নিয়ম মেনে মহিষ বলি দেওয়া হত। একসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত মহিষ মারা যায়। তারপর বন্ধ হয়ে যায় মহিষ বলি প্রথা। কথিত আছে, একবার পুজোর ঠিক আগে বন্যা হয় কাঁথিতে। সেই বন্যায় বাড়ির গোশালা ভেঙে পড়ে। গোশালায় দেবী দুর্গার নামে উৎসর্গীকৃত মহিষটি দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। আর এই মহিষের মৃত্যুতে সে বছর থেকেই যাদব রাম রায়ের পারিবারিক পুজোয় পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। পশুবলির পরিবর্তে আখ ও চালকুমড়ো বলি শুরু হয়। তবে এখনও সেই বলি দেওয়ার অস্ত্র পূজিত হয় রাজবাড়ির পুজোয়। মন্দিরের ডানদিকে একটি চালাঘরে বলি দেওয়ার সেই অস্ত্রগুলো আচার মেনে পূজিত হয়ে আসছে কয়েকশো বছর ধরেই।

    এই পুজোয় নিয়মকানুন এখনও অটুট। নিয়ম মেনে আজও হোমাগ্নি জ্বালানো হয় আতস কাচে সূর্যের আলো ফেলে। কিশোননগর গড়ের দুর্গাপুজো হয় পশ্চিমমুখী ঘটে। শোনা যায়, নরোত্তম বর নামে এক মাঝির কণ্ঠে চণ্ডীমঙ্গল গান শোনার জন্য স্বয়ং দেবী দুর্গা পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন। তারপর থেকে সেভাবেই ঘট স্থাপন করা হয়ে থাকে।

    জমিদার বংশের সদস্য কৃষ্ণা মিত্র চৌধুরী শোনান রাজ পরিবারের পুজোর কাহিনি। তাঁর কথায়, ”ছোটবেলায় শুনেছি, জমিদার যাদবরামের রায়ের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর। একবার দুর্গাপঞ্চমীর গভীর রাতে দেবী নিজে কিশোরনগর থেকে ছ’মাইল দুরে মশাগাঁ গ্রামের খালের ঘাটে ষোড়শীর বেশে উপস্থিত হন। ঘাটের মাঝি নরোত্তম বরকে অনুরোধ করেন, কিশোরনগর গড়ের পুজো দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌকায় খাল পার করে দেওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করতে থাকেন দেবী। নরোত্তম খাল পার করে দিলে পারানির কড়ির বদলে ষোড়শী তাঁকে দিলেন একটি পুঁথি। কিন্তু নিরক্ষর নরোত্তম বলেন, ‘মূর্খ আমি। পুঁথি কোন কাজে লাগবে?’ তখন ষোড়শী বলেন, ওই পুঁথি নিয়ে কিশোরনগর গড়ে গিয়ে দুর্গামন্দিরে গান করতে। সেইমতো নরোত্তম দুর্গাপুজোয় চণ্ডীমঙ্গল গাইতে এলেন। রাজা যাদবরাম রায় জাত্যাভিমানে তাকে মন্দিরে উঠতে দেননি।

    মনের দুঃখে নরোত্তম মন্দিরের পিছনে পশ্চিমদিকে বসে চণ্ডীমঙ্গল গান শুরু করেন। আর ঠিক তখনই দেবীর বোধন ঘট পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমমুখে ঘুরে যায় আপনা আপনি। ভুল বোঝেন রাজা। সেই থেকে পশ্চিমমুখী ঘটেই দেবীদুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। নরোত্তম বরের বংশধরেরা আজও আসেন। গড়ের পুজোয় চণ্ডীমঙ্গল গান করেন।

    সময় বদলে গিয়েছে। গড়ের ঝাড়লণ্ঠন, নাটমন্দির, নহবত খানা হারিয়ে গিয়েছে কবেই। তবু আজও পঞ্চমুণ্ডির আসনে, পুরনো আটচালা মন্দিরেই এখনও পুজো হয়। সেই জাঁকজমক নেই। তবে প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারেই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। দুর্গাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত কিশোরনগর গড়ে মেলা বসে। সাধারণ মানুষের কাছে তা ‘গড়ের মেলা’ হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেছে। রাজ পরিবারের সদস্যদের কথায়, এখানে প্রতিবার সন্ধিপুজোর সময় মহিষ বলি দেওয়ার রীতি ছিল। নিয়ম মেলে রাজতিলক কেটে মহিষ বলি দেওয়া হত। এক সময় পুজোর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেওয়াল চাপা পড়ে মায়ের নামে উৎসর্গীকৃত মহিষের মৃত্যু ঘটে। তারপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় পশুবলি প্রথা। তবে বলির কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র আজও পূজিত হন। কয়েকশো বছর ধরে এই অস্ত্র পূজিত হয়ে আসছে। তাছাড়া সারাবছর এই অস্ত্রের সামনে ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা দেওয়া হয়।
  • Link to this news (প্রতিদিন)