অনিমেষ মণ্ডল, কাটোয়া: অনুশীলন সমিতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন পূর্বস্থলীর রমণীমোহন চক্রবর্তী। তিনি কলেজ জীবনে গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। পরে রমণীমোহন গুপ্ত সমিতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে অন্যান্য বিপ্লবীদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ প্রশাসনের দ্বারা একাধিকবার গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হন। যার ফলে প্রেসিডেন্সি, হুগলি, আলিপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং সাতক্ষীরা সহ বিভিন্ন জায়গায় কারাবরণ করেন।
১৯১৪সালে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার শিবপুর থানার অন্তর্গত উমেদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমণীমোহনবাবু। তাঁর বাবা ছিলেন রেবতীকান্ত চক্রবর্তী। মা সুধামণি দেবী। তিনি তাঁর নিজের শহর উমেদপুরে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএ এবং মোক্তারি পাশ করেন। রমণীমোহনবাবু ছাত্রজীবনে ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ষোল বছর বয়সে তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরপরই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য ইংরেজ পুলিস তাকে গ্রেপ্তার করে। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ভালো ফলাফলের খবর পান। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আইন কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বিপ্লবের নামে ছুটে বেড়ানো আটকাতে তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। পঁচিশ বছর বয়সে রেনুকণাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এইসময়ে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল ঘোষ, হেমন্ত বসুর মতো বিখ্যাত বিপ্লবীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ পান। ১৯৩২ সালে কলকাতায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় রমণীমোহনের উপর লাঠিচার্জ করে ব্রিটিশ পুলিস। যারফলে তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন মণিপুরে আনন্দ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন তখন রমণীমোহন নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে সেখানে যান। এমনকী অল্প সময়ের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। একরাতে ফরিদপুরে রমণীমোহনের বাড়িতে নেতাজি তাঁর দুই সহকারীকে নিয়ে এসেছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন বিপ্লবীকে নিয়ে গোপন বৈঠক করছিলেন। সেই খবর পৌছয় ব্রিটিশ পুলিসের কাছে। গ্রেপ্তার করতে আসছে শুনে সবাই পালিয়ে গেলেও নেতাজি তাঁদের শোবার ঘরে আত্মগোপন করেছিলেন। রেনুকণাদেবী তাঁকে লেপ-তোশক দিয়ে মুড়ে রেখেছিলেন। ঘরে নেতাজিকে না পেয়ে ফিরে যায় ব্রিটিশ পুলিস। অসমের গুয়াহাটিতে বিপ্লবীদের ডেরায় হাজির হতে গিয়ে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যান রমণীমোহন। সেইসময় সঙ্গীদের নাম না বলায় তাঁর আঙুলে নখের নীচে সুচ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেও কারও নামই রমণীর মুখ দিয়ে রেব হয়নি। তাঁকে দ্বীপান্তরের ভয় দেখানো হয়। ১৯৪৭সালে দেশ বিভক্ত হবার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলায় গঙ্গার ধার বরাবর পূর্বস্থলীতে এসে বসবাস করেন। পলাশপুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলান। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবদানে ১৯৭২সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রমণীমোহনকে তাম্রপত্র দিয়ে বিশেষ সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। ২০০৭সালে তাঁর জীবনাবসান হয়। • রমণীমোহন চক্রবর্তী