• স্বাধীনতা সংগ্রামের সোনালী ইতিহাস
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ আগস্ট ২০২৫
  • অভিষেক রায়

    ‘আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ে
    হেনেছে নিঃসহায়ে ।
    আমি যে দেখেছি— প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
    আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
    কি যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।

    ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত সাড়ে নটা। হিজলি বন্দি নিবাসে থাকা বন্দীরা রাতের খাওয়া সেরে শুতে যাওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করছিলেন। সেই সময় একদল রক্ষী দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে বন্দিদের উদ্দেশে গালিগালাজ করতে করতে এগিয়ে আসে । আচমকাই তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। সামনে থাকা কয়েকজন বন্দীকে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করে। গোবিন্দপদ দত্তের একটা হাত নষ্ট হয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রক্ষীদের এই অত্যাচার দেখছিলেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত এবং সন্তোষ মিত্র । দুজনেই গুলিবিদ্ধ হন এবং সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। বন্দিনিবাসের হিমাংশু বসু তারকেশ্বর এবং সন্তোষের ছবি স্কেচ করে রাতের ঘটনাবলীর বিবরণ কালিবিলাস এবং শ্রীমন্ত ভট্টাচার্যের মায়ের হাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন বিশেষ সংস্করণ বার করে সেই খবর প্রচারিত হয়। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিজলি বন্দিনিবাসে ছুটে আসেন। সন্তোষ মিত্র ছিলেন নেতাজির সহপাঠী। দুই বিপ্লবীর প্রাণহীন মৃতদেহ গ্রহণ করে কলকাতায় ফিরে আসেন যতীন্দ্রমোহন এবং সুভাষচন্দ্র । পরবর্তী সময়ে শহিদ মিনারের নিচে স্মরণসভায় উপস্থিত হয়ে দুই তরুণের মৃত্যু যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে উচ্চারিত হয় প্রশ্ন কবিতাটি।

    ‘কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীত হারা, অমাবস্যার কারা
    লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।
    তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—
    যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
    তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’

    গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের শুরুতে বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র কার্যকলাপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। শিক্ষিত বাঙালিদের বন্দি করে হিজলী বন্দীনিবাস এবং ডুয়ার্সের বক্সা বন্দীনিবাসে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সেই বন্দী নিবাসে বন্দীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে দুজনকে মেরে ফেলার ঘটনা বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো উদ্দীপ্ত করে তোলে।

    হিজলীর এই বন্দিনিবাসে দিন কাটিয়ে গিয়েছেন অনন্ত সেন, জ্যোতিষ জোয়ারদার, নিকুঞ্জ সেন, নৃপেন চক্রবর্তী, সুধী প্রধান, ত্রিদিব চৌধুরী, ননী ভট্টাচার্য, ক্ষিতীশ রায়চৌধুরীর মতো অনেক স্বনামধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী। হিজলি বন্দিনিবাস থেকে সামান্য দূরে মহিলাদের জন্য ছিল আলাদা জেল৷ এই জেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন কল্পনা জোশি, কমলা দাশগুপ্ত, কমলা চট্টোপাধ্যায়, চারুশীলা দেবী, লাবণ্যপ্রভা দত্তর মতো মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।

    ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সোনালী ইতিহাসের চিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিজলী বন্দিনিবাস এবং সংলগ্ন মহিলা জেল। ১৯৫১ সালে হিজলী বন্দিনিবাসেই শুরু হয় ভারতের প্রথম আইআইটির পথ চলা। পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় আইআইটির নতুন ভবন। আইআইটি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় হিজ​লী বন্দিনিবাসে এখন জওহরলাল নেহরুর নামাঙ্কিত টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম। মহিলা বন্দী নিবাসের অবস্থা অবশ্য ভালো নয়। এই জায়গাটিকে আইআইটির পরিত্যক্ত জিনিসের গুদামঘর হিসেবেই ব্যবহার করা হয়।

    অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী আইআইটি নির্দেশকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই উজ্জ্বল অধ্যায়কে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্য বাংলা ভাষাতেও হিজলি বন্দিনিবাসের ইতিহাস তুলে ধরার কথা জানিয়েছেন।

    হিজলি বন্দিনিবাসই সেই জায়গা বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যা এক মঞ্চে এনেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)