• ‘যদি পাখি হতে পারতাম’
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ আগস্ট ২০২৫
  • বিপ্লব ঘোষ

    ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে মনে পড়ে সেই আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি। ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তে হত পাড়ার মাঠে। অনেক ছেলেমেয়ে মেয়ে সাদা পোশাক ও সাদা মোজা, কেটস পরে স্বাধীনতার পতাকা হাতে। সামনে যে থাকত তার হাতে বড়। সে সবার আগে হাঁটবে। আশেপাশের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করতাম গান ও বাজনার তালে। সেই সব স্বদেশী গান। সবার আগে ও পিছনে থাকত আমাদের দাদারা। তারা ক্লাবের কর্মকর্তা। তারাই এই আয়োজনের আসল লোক। শেষ হত সেই মাঠে এসে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল। শেষের সবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তখন আমরা কেউ দশ থেকে পনের যুবক যুবতী। এক সপ্তাহ আগে থেকে রিহার্সাল হত মহা আনন্দে। আসলে আমরা জানতাম স্বাধীনতা দিবসের দিন থাকলে মিষ্টির প্যাকেট পাব। আরো একটি কারণ না বললেই নয় তা হল ওই দিন পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে মেয়েরা আসত। তাদের সঙ্গে কয়েকটি দিন একসঙ্গে কাটান বাড়তি পাওনা। তা মিষ্টির থেকে কম নয়! পরে শোনা যেত ওই দিনগুলির জন্য কারও প্রেমে বসন্ত এসেছিল।

    আমার জন্ম স্বাধীনতার ছ’বছরের পর। তখন এই দিনের কোন ধারনা স্বাভাবিকভাবেই আসেনি। পরে দেখেছি স্কুলে, রাস্তার মোড়ে এবং অনেকের বাড়িতে ওই তিন রঙা পতাকা উড়ছে। তখন বড়দের বক্তব্য শুনে বুঝতাম,আমাদের দেশ পরাধীন ছিল। স্বাধীনতার অর্থ কারও অধীন নয়। বৃটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা মুক্ত হই ইংরেজদের থেকে। পশ্চিমবাংলা থেকে বহু বাঙালি ধারাবাহিক ভাবে সংগ্রাম ও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। আরো শুনতাম মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসু-র কথা। আর জেনেছি আন্দামানের সেলুলার জেলে এই দেশের বহু স্বাধীনতার বীর সংগ্রামীদের রাখা হয়েছিল এবং ফাঁসি দেওয়া হয়। আর ওখানে রাখার অন্যতম কারণ কেউ চাইলে পালাতে পারবে না। চারিদিক সমুদ্র। কালাপানি বলা হত। তারপর তো বই পড়ে কিছু জানি। তাদের সেই ত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

    আজ আমার জীবন উপান্তে এসে বারবার মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা। তাঁরা আজ কেউ বেঁচে নেই। সেইসময় পূর্বপাকিস্তানের ফরিদপুরের রামভদ্রপুরে ছিল বাবা-মায়ের দেশ। এই বাংলায় বাবা মাঝেমধ্যে আসতেন জীবিকার সন্ধানে। কারণ সেখানে সামান্য ঘরবাড়ি ও কিছু জমিজমা ছিল। আর একটি মুদির দোকান। সবই ছিল পদ্মা নদীর গা-য়ে। বাবার মুখে শুনেছি, আটবার সেই পদ্মা নদী ভাসিয়ে নিয়েছে। এরকম অনেকের এই দশা হত। তাই তাকে কীর্তিনাশা বলে। তখন দূরে সাজনপুরে কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মা-কে রেখে আসতেন বাবা। তিনি বেরিয়ে পড়তেন একটু ভাল ভাগ্যের সন্ধানে। জল নামলে আবার সেই জায়গাতেই মাটি, বেড়া ও টিন দিয়ে ঘর তুলতেন। অর্থাভাবে এই বাংলায় এসে একপ্রকার ভিখিরির মত চেনা জানা মানুষ খুঁজে কাজের কথা বলতেন। যদি কিছু সুরাহা হয়। এই জন্যেই মা পড়াশোনা করতে পারলেন না। বাবা তবু ম্যাট্রিক পাশ করেন। আর এই জন্যই এই বাংলায় এক জীবনবীমা অফিসে কাজ পান।

    তারপর ১৯৪৮ সালে বাবা-মা চলে আসেন এই বাংলায় ১ বছরের ছেলেকে নিয়ে। মানে সে আমার বড়দা। যার আটবার ঘর নিয়েছে পদ্মা, তার কাছে তখন এই বাংলা স্বর্গ হলেও বাবা কখনও সেই দেশের কথা, ফরিদপুর কথা ভুলতে পারেননি। রামভদ্রপুরের সেই খেলার মাঠ, আমবাগান, পুকুর, ক্ষেতখামারের, বন্ধুবান্ধবদের গল্প করতেন আমাদের। দেখতাম আনমনে কখন চোখ মুছছেন। মা বলত, আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল। ওরা সবাই পাঠশালায় যাইত। আমি আর যাইতে পারলাম না ওই পদ্মার জন্য। খাওয়াই তো ঠিক কইরা জুটত না। গ্রামের কথা খুব মনে পড়ে। শত হইলেও নিজের দ্যাশ তো! আমি এসব শুনে ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একবার বাবা-মায়ের দেশের ওই গ্রামে যাব। বাবাও বলেছিল তোদের সবাইকে নিয়ে দেশ দেখাতে নিয়ে যাব। যখন বাবা ভাল উঁচু পদে সুযোগ পেলেন। কলকাতায় বাড়ি করলেন। আমাদের চার ভাই বোনদের মানুষ করলেন। কোন কষ্ট হতে দেননি। দুবেলা মাছের অভাব ছিল না। নদীর পারের মানুষ ছিলেন, মাছ খুব ভালবাসতেন।

    আমি সামান্য লিখি। আমার অনেক বন্ধু এখনকার বাংলাদেশে থাকে। ওরা নিত্য ডাকে। কবিতা পড়তে। যাওয়া হয়নি। একবার যাব। সেবার ইছামতীতে লঞ্চে করে সারাদিন ঘুরছিলাম। বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওপারে বাংলাদেশের গৃহবধূ জল আনতে এসেছে কলসী কাঁখে, কেউ বা স্নান করতে। কোথাও কেউ গল্প করছে। আর নাই রে বেলা… আর একটু দূরে দেখি বিশাল কেয়াবন। মনটা হু হু করে উঠল। কেবলই মনে হল আমার বাবা-মায়ের দেশের মানুষেরা ওপারে। আর আমি ইচ্ছে হলেও যেতে পারি না। সীমান্তের তারকাঁটা আমায় যেতে দেয় না! যদি পাখি হতে পারতাম! ওদের তো কোন সীমান্ত নেই। যদি পাখি হতে না পারি তবে যেন মেঘ হতে পারি।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)