• স্বদেশচেতনা থেকে ‘জিঙ্গোইজম্’
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ আগস্ট ২০২৫
  • অতনু রায়

    আমাদের দেশের ছবিতে স্বদেশচেতনার সূত্রপাত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই। বলতে গেলে, বিংশ শতাব্দীর তিন ও চার-এর দশক থেকে। দাদাসাহেব ফালকে, বাবুরাও মিস্ত্রীর মতো কিংবদন্তিদের হাত ধরেই শুরু বললে খুব ভুল বলা হয় না। যদিও তাঁদের কাজ স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ছিল না, তবে ‘কালচারাল ন্যাশনালিজম’ হিসেবে দেখা যেতেই পারে যা ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে দাঁড়িয়েও এক স্বতন্ত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র ভাষ্য আর অভিব্যক্তির সূচনা করেছিল।

    ১৯৪১ সালে সোহরাব মোদীর ‘সিকান্দার’ যেমন স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন ‘আমরাও পারব’র আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। পৃথ্বীরাজ কাপুর সেই ছবির আলেকজান্ডার! রাজা পুরু’র প্রতিরোধের কাহিনী ব্রিটিশদের প্রতি চোখরাঙানি ছিল সে তো এই ছবি নতুন করে দেখলেই বোঝা যায়।

    দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বদেশচেতনার ছবির ধারা বদলে গেল। কারণ, শত্রু বদল। ব্রিটিশ আর শত্রু নয়। সামাজিক কুসংস্কার, কুপ্রথা, দুর্নীতি নতুন শত্রু তখন। একদিকে ১৯৫৪ সালে সত্যেন বোসের ‘জাগৃতি’ সুভাষচন্দ্রের আদর্শে যুবশক্তিকে নতুন করে দেশ গড়ার ডাক দিচ্ছে। আর, অন্যদিকে ১৯৫৭ সালে মেহবুব খান তাঁর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে কৃষক সংগ্রামের গল্প বলার ছলে রাধা চরিত্রের মধ্যেই দেশমাতৃকার অন্বেষণ করেছেন। সেই ছবি হয়ে উঠল নতুন ভারতের ছবি। সারা দেশ ‘মাদার ইন্ডিয়া’ জ্বরে আক্রান্ত তখন। শুধু দেশ কেন, প্রথমবার সেরা বিদেশি ছবির জন্য অস্কার নমিনেশন পর্যন্ত পেল! চোখের সামনে দেখা গেল দিন বদলের পালা।

    শুনলে আশ্চর্য হবেন, মেহবুব খান ১৯৪০ সালে, মানে স্বাধীনতার আগে একটা ছবি বানিয়েছিলেন, ‘অউরত’। ছবিটা মানুষ ততটা গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে সমস্ত কিছু বদলে গেল। তখন মেহবুব ঠিক করেন নিজের ছবি রিমেক করবেন। ‘অউরত’ রিমেক হল। সেই ছবিই ‘মাদার ইন্ডিয়া’। আসলে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট বদলে দিয়েছিল একটা দেশের মানসিকতা।

    ১৯৬০-এর দশকে ভারতীয় স্বদেশচেতনার ছবিতে জায়গা করে নিল যুদ্ধের ছবি। এ যেন জানিয়ে দেওয়া যে, লড়াই আমাদের রক্তে। চেতন আনন্দ ১৯৬৪ সালে ভারত-চীন ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি করলেন ‘হকীকত’। টগবগিয়ে উঠল তীব্র জাতীয়তাবাদ। পর্দায় দেশপ্রেমের উপস্থাপনায় এক নতুন মোড় আসল। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগকে শ্রদ্ধা জানানো শুরু হল।

    ১৯৬০-এর দশক। ততদিনে দুই কিংবদন্তি বঙ্গসন্তান সলিল চৌধুরী আর মান্না দে’র জুটিতে হয়ে গেছে এক যুগান্তকারী গান। ‘অ্যায় মেরে প্যারে ওয়তন, অ্যায় মেরে বিছড়ে চমন; তুঝপে দিল কুরবান’। স্বদেশচেতনার বেঞ্চমার্ক বলা চলে। ঠিক সেই সময়ে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিছু হিট ছবির এক নায়ক ১৯৬৫ সালে এস. রাম শর্মার ‘শহীদ’ ছবির ভগৎ সিং চরিত্রে অভিনয় করে হয়ে উঠলেন ‘আইকন’। ভারতীয় সিনেমার আকাশে ঝলমল করে উঠল এক জ্যোতিষ্ক, মনোজ কুমার। ১৯৬৭ সালে এসে মনোজ হলেন স্বদেশচেতনার ছবির পোস্টার ফেস। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিকায় পরিচালনা করলেন নিজের প্রথম ছবি ‘উপকার’। তাঁর ছবির সংলাপ হয়ে উঠল স্লোগান। মুখে মুখে ফিরল ‘ভারতমাতা কী জয়’। কন্ঠে কন্ঠে ছড়াল ‘মেরে দেশ কী ধরতি সোনা উগলে, উগলে হীরে মোতি’। মনোজ কুমার হয়ে উঠলেন ‘ভারত কুমার’।

    ১৯৭০-এর দশকে এসে আরও বদলে গেল সবকিছু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর। তবে মনোজ কুমারের ছবি হিসেবে আসল ‘পুরব অউর পশ্চিম’ এর মতো ছবি। ১৯৮০-এর দশকে এসে স্বদেশচেতনার ছবির পথ কিছুটা থমকে গেল। ‘ক্রান্তি’র মতো ছবি এলেও অনেকটা ফর্মুলাবন্দি হয়ে পড়ল ভারতীয় স্বদেশচেতনার ছবি।

    ১৯৯০-এর দশকে বিশ্বায়ন আর মুক্ত অর্থনীতি বিশ্ব সিনেমার ভাষা সম্পূর্ণ বদলে দিল। ভারতীয় ছবিরও। পর পর আসতে থাকল ‘প্রহার’, ‘তিরঙ্গা’, ‘ক্রান্তিবীর’, ‘১৯৪২: আ লভ স্টোরি’, ‘বর্ডার’, ‘পুকার’, ‘সরফারোশ’-এর মতো ছবি।
    ২০০০-এর দশকেও সেই ধারা বজায় থাকল। ২০০১-এ আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘লগান’ হয়ে উঠল জাতীয় গর্বের প্রতীক। আবার ২০০৬ সালে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা’র ‘রঙ্গ দে বাসন্তী’ যুবসমাজকে নতুন করে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করল। পরের বছরেই শিমিত আমিনের স্পোর্টস ড্রামা ‘চক দে! ইন্ডিয়া’ নারীশক্তির জয়ধ্বজা তুলে ফিরিয়ে আনে সেই অমোঘ সত্য, দেশ আসলে ‘মা’।

    যুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি হওয়া ছবি ক্রমশই মানুষের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে জায়গা করে নেয়। সেই ফর্মুলা মাথায় রেখেই তৈরি হল ‘ট্যাঙ্গো চার্লি’, ‘মিশন কাশ্মীর’, ‘এলওসি কার্গিল’, থেকে শুরু করে ফারহান আখতারের ‘লক্ষ্য’ বা শ্রীলঙ্কান সিভিল ওয়ারের পটভূমিকায় সুজিত সরকারের ‘মাদ্রাস ক্যাফে’। বলতে হবে ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’, বা ‘দ্য গাজি অ্যাটাক’ ছবির কথাও।

    তবে এই ট্র্যাডিশনে বেশ কিছুটা আগে থেকেই যুক্ত হয় জীবনীছবিও। ব্যক্তি শৌর্যের অকথিত গাথা দর্শকের মন ছুঁয়েছে বারবার। ‘শহীদ’ এর ধারা মেনে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’, ‘নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস: দ্য ফরগটন হিরো’, ‘মঙ্গল পান্ডে: দ্য রাইজিং’। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। হালের ‘শেরশাহ’, ‘সর্দার উধম’, ‘সাম বাহাদুর’, তালিকা অন্তহীন। আমাদের স্বদেশচেতনার ছবি চিরকালই আসলে বহুমাত্রিক। আজ তা শুধু যুদ্ধ বা বিপ্লবের গল্প নয়, বরং সমাজের নানা স্তরের সংগ্রাম, বিজ্ঞান, নারীশক্তির কথা বলে।

    তবে সাম্প্রতিক অতীত বলছে, সেনাবাহিনীর বীরত্ব বাণিজ্যিক সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। বর্তমানে ভারতীয় ছবিতে ‘জিঙ্গোইজম্’ বা উগ্র দেশাত্মবোধের ক্রমবর্ধমান ধারণা প্রশ্ন তুলেছে। বিবর্তন তো অবশ্যম্ভাবী। ডিজিটাল আগ্রাসন, সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও ভারতীয় ছবির পরিচালকরা দেশপ্রেমের উদযাপনে আরও সচেতন হয়ে উঠবেন নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই এমন ছবি আরও হবে যা গভীর হবে, একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ করবে ‘স্ট্যাটাস-ক্যুও’কেও। কিন্তু কখনোই ছবি ইতিহাস আর সত্যকে বিকৃত করবে না। বীরত্বকে চিত্তাকর্ষক রূপ দিতে হিংস্রতাকে অলীক উচ্চতায় পৌঁছে মান্যতা না দেওয়ার দিকেও নজর রাখবেন সবাই নিশ্চয়ই। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতীয় ছবির সব দর্শকের হয়ত এটাই মনের কথা।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)