• আমার স্বাধীনতা দিবস
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ আগস্ট ২০২৫
  • সুদীপ সরকার

    অফিস থেকে বেরোনোর খানিক আগে এলো খবরটা। সন্ধ্যের মুখে ডাকাডাকি করেও কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, দিন শেষে সবার তখন ঘরে ফেরার তাড়া। কিন্তু এমন একটা খবর পাওয়ার পরেও চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। সাতপাঁচ না ভেবে ধরলাম তরুণবাবুকে, ভদ্রলোক আমার নীচের তলায় একটা ঘর নিয়ে থাকেন একাকী। আসলে দ্বিতলবিশিষ্ট পুরো বাড়িটাই মহকুমাশাসকের জন্যে বরাদ্দ। আমি একা থাকি, এত বড় বাড়িতে একা থাকাটাও কম ঝক্কির নয়, তরুণবাবুকে তাই নীচের তলায় থাকার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। ছুটিছাটায় নীলিমা আর তৃণা এলেও কোন অসুবিধা হয় না, ওপরে প্রায় খান চারেক বড় বড় ঘর, বারান্দা নিয়ে বিরাট ফ্ল্যাটে পাখির বাসার মত তিনটে শহুরে ফ্ল্যাট ঢুকে যাবে চোখ বুজে। তরুণবাবু বয়স্ক মানুষ কিন্তু উৎসাহের কোন খামতি নেই তাঁর, এককথায় তৈরি হয়ে গেলেন, গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, ‘স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বাল্যবিবাহ, যে কোন মূল্যে ঠেকাতে হবে।’ আগে থেকে পুলিশের বন্দোবস্ত করে রেখেছিলাম, এনজিও-র লোক আমাদের বিয়েবাড়ির চৌহদ্দিতে নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের মেঠো পথ ধরে মিনিট তিনেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম বিয়েবাড়িতে। সেখানে তখন বিয়ের আসর জমজমাট, গরীব ঘরের মেয়ের বিয়ে, কিন্তু জাঁক কম বলা যাবে না। ছাদনাতলায় পুরুতমশাই গুছিয়ে বসেছেন নানা সামগ্রী সাজিয়ে, রান্নার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। পুলিশের লোকজন বাড়ির বাইরে রেখে গুটিগুটি পায়ে ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছি সবার অলক্ষ্যে। ইতিউতি কিছু লোককে দেখলাম ব্যস্ত হয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। পুরুত বাবাজির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘লগ্ন ক’টায় গো? মেয়ের বাবা কই?’ শেষ মুহূর্তের গোছগাছ দেখে নিতে ব্যস্ত পুরুতমশাই তেমন একটা আমল দিলেন না আমাকে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘সময় হয়ে এসেছে, মেয়েকে নিয়ে আসেন এবার।’

    মনে বললাম, করাচ্ছি তোমার বিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘সময় তোমার হয়ে এসেছে ঠাকুরমশাই, চল আমার সঙ্গে, দুটো দিন জেলে ঘুরে আসবে, তারপর নয় বিয়ে টিয়ে হবে!’
    এবারে তরুণবাবু এগিয়ে এলেন, জোর গলায় বললেন, ‘কোথায় মেয়ের বাবা, ডাকো তাকে।’
    পুরুত বেচারির তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। মুহূর্তে লোক জমে গেল, মেয়ের বাবা কেঁদে পড়লেন, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান পৌঁছে গেলেন। আর তখন লোকজন বলল, সত্যি তো, এত ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। বরের বাড়ির লোককেও সতর্ক করা হোল, এমন বিয়ে যে আইনবিরুদ্ধ, সেসব বোঝানো হোল বিশদে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বললাম আলাদা করে, দেখলাম বিবাহ নিয়ে তার কোনো সম্যক ধারণাও নেই, সেটাই স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাম কি তোমার?’

    লাজুক মেয়েটি আস্তে বলল, ‘মুক্তি।’ ওর মুখে যেন আমার তৃণার মুখটা দেখলাম, বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠল, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি এই অন্ধকার থেকে আমার দেশের মেয়েদের মুক্তি মিলবে না? এত সচেতনতা, এত আলাপ আলোচনার পরেও তো মেয়েরা আজও বস্তাবন্দি পণ্যের মত পাচার হয়ে যায় মোটা টাকার বিনিময়ে। কন্যা সন্তান আজও বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর একটু বড় হতে না হতেই অপরিণত শরীর মন নিয়ে গিয়ে আটকা পড়ে অন্য কোনো চার দেওয়ালের গণ্ডীতে। সেদিনের সেই মেয়েটিকে আজও ভুলিনি, যেমন ভুলিনি নন্দীগ্রামের সেই সতেরো বছরের মেয়েটাকে। বাড়ির লোকেরা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, এই অভিযোগ নিয়ে সটান এসে হাজির হয়েছিল স্কুলের বড় দিদিমনির বাড়িতে। তারপর থানা-পুলিশ, গতানুগতিক প্রশাসনিক তৎপরতা আর অন্ধকার রাতের শেষে ভোরের আলো ফোটা। মহা শক্তিধরের কাছে সবসময় এই প্রার্থনাই করেছি, আমার দেশের সব মেয়েরাই যেন ভালো থাকে, তারাই তো অর্ধেক পৃথিবী, অর্ধেক আকাশ! দেশ অনেক এগিয়েছে, মেয়েরাও পিছিয়ে নেই; মেধায় উদ্দীপনায় তারা ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। তবুও পোড়া দেশের আনাচে কানাচে চোখ রাখলেই আজও দেখা যায় সাবধানবাণী, ‘কন্যাভ্রূণ হত্যা মহাপাপ কিংবা, এখানে নিও ন্যাটাল টেস্ট করা হয় না, এটি দণ্ডনীয় অপরাধ’। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরোতে না পারা অভাগা সমাজকে আজও প্রতিনিয়ত মনে করাতে হয় আইনের কথা, পাপ পুণ্যের মোড়কে দিতে হয় নৈতিকতার পাঠ। মুক্তির বিয়ে আটকে সেদিন বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছিল, সবুজ সঙ্ঘের মাঠে তখন ‘মধ্য রাতের স্বাধীনতা’ উদ্‌যাপনে ব্যস্ত আট থেকে আশি। আলোর মালায় সেজে ওঠা মাঠের মাঝখানে দেখলাম পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা, নিজের মনেই অনুচ্চারে বললাম, ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির।’ ইচ্ছে হলো গাড়ি থেকে নেমে পড়ি, কচিকাঁচাদের ভিড়ে মিশে যাই। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলি, বাচ্চারা দেখো, এই আমার দেশ, এই আমার দেশের মানুষ। এসো সবাই মিলে গেয়ে উঠি, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’

    পনেরোই আগস্ট এলেই ছেলেবেলার দিনগুলোয় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আমরা তখন ক্লাস নাইন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্বাবধানে স্কুলে জমজমাট অনুষ্ঠানে নানা ইভেন্টের সমাহার। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনে আমরা গেয়েছিলাম ‘উঠ গো ভারত লক্ষ্মী, আও বাচ্চ তুমহে দিখায়ে ঝাকি হিন্দুস্তান কী’। অভিজিৎস্যার তাঁর গ্রুপ নিয়ে গেয়েছিলেন ‘আজ যত যুদ্ধবাজ, দেয় হানা হামলাবাজ।’ ক্লাস ইলেভেনের দিদিরা গেয়েছিল, ‘চল রে চল সবে ভারত সন্তান’। অনেক পরে জেনেছিলাম, এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, এটি আসলে তাঁর মেজো দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। এরপর থাকত আরও মজার একটি অনুষ্ঠান, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বলা ভালো, আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ওপর মজার প্রশ্নোত্তর পর্ব। উত্তর দিতে পারলেই একটা পেন উপহার পাওয়া যেত। সেই উন্মাদনা আজও স্মৃতিপটে অমলিন। স্কুলের ওই কুইজেই জেনেছিলাম, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের স্বাধীনতা দিবসকে এক বছর এগিয়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৭-এ নিয়ে এসেছিলেন দেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান অশান্তি বন্ধ করার তাগিদে। আবার ১৯৪৭-এর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতের উদ্‌যাপনে ছিলেন না স্বয়ং জাতির জনক গান্ধীজী, তিনি সেদিন ছিলেন কলকাতায়। বাংলার আকাশে সেদিন ছিল সাম্প্রদায়িক অশান্তির কালো মেঘ। জেনেছিলাম, ১৫ আগস্ট আমাদের মতই আরও পাঁচ পাঁচটা দেশ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, কঙ্গো, বাহ্রেন ও লিঞ্চেন্সটাইন নামক একটি ছোট্ট ইউরোপিয় দেশ। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে। এমনি দিনেও স্কুলের শুরুতে প্রার্থণার শেষে জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম আমরা। জীবনের মধ্য গগনে পৌঁছেও কেন জানি না জাতীয় সঙ্গীতের সুর কানে এলেই আজও সেই আবেগ অনুভব করি। শরীর মনে রোমাঞ্চ জাগে ছেলেবেলার মতই। মাঝে মাঝে ঔৎসুক্য জাগে, জানতে ইচ্ছে করে, আজকের প্রজন্মের ছেলে মেয়েদেরও কি এমনটা হয় নাকি তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি বাস্তববাদী, কারণে অকারণে আবেগ তাড়িত হওয়া তাদের ধাতে সয় না।

    স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এখনো কি ছোট ছেলে মেয়েরা স্কুলের অনুষ্ঠান নিয়ে উদ্বেলিত হয়, নাকি তেমন করে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন হয় না এখন? তৃণা এখন কলেজে যাওয়ার মুখে, ওদের জীবনবোধ আমাদের থেকে অনেকই ভিন্ন, আমাদের সংস্কার, ঐতিহ্য নিয়ে ওদের খুব একটা উৎসাহ আছে বলে মনে হয় না। জানি না, আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই জাতীয়তাবোধ চারিয়ে দিতে পেরেছি কি না! যদি না পারি, সে ব্যর্থতার দায়ও তো আমাদের ওপরেই বর্তায়! কর্মসূত্রে পদমর্যাদার কারণে বহু সরকারি অ-সরকারি অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবসের সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সুযোগ পেয়েছি, প্রত্যেক বার মনে মনে শপথ নিয়েছি নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে সম্পাদন করব, যেটুকু সম্ভব মানুষের পাশে থাকব। এইভাবেই দেশ মাতৃকার সেবায় একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। এ আমার অন্তরের বিশ্বাস। স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনে আমাদের ছোট্ট আবাসনের মাঠেও প্রস্তুতি সারা, প্রবীণ আবাসিকের কম্পমান হাতের দড়ির টানে উত্তলিত হবে জাতীয় পতাকা। পাশের ক্লাব থেকে ভেসে আসছে সেই চিরস্মরণীয় গান, উদাত্ত কণ্ঠে সবিতাব্রত যেন নিজেই গাইছেন, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান…।’
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)