ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে মেরুদন্ড! কোন ভয়ঙ্কর পরিণতি?...
আজকাল | ১৭ আগস্ট ২০২৫
গোপাল সাহা
অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডেলাইটিস নামটি শুনলেই মনে হয় ভয়ঙ্কর কোনও রোগ, তবে ভাবনাটা একেবারেই ভুল নয়। এটি এমন একটি রোগ যার শুরুটা চোখ লাল বা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টে বা মেরুদণ্ডে ভয়ঙ্কর ব্যাথা-সহ একাধিক উপসর্গ অনুভব হয়। যার সঠিক চিকিৎসা সঠিক সময় হওয়াটা খুবই জরুরি। আর সেই চিকিৎসা পেয়েই জীবনের মূল স্রোতে ফিরলেন শহর কলকাতার বাসিন্দা বরুণ ব্যানার্জি (৫২)। তাঁকে জীবনের মূল স্রোতে ফেরালেন চিকিৎসক (রিউমেটলজিস্ট) অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়।
অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস সম্পর্কে প্রথমে একটু জেনে নেওয়া যাক:
অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (Ankylosing Spondylitis) একটি প্রদাহজনিত বাতজনিত রোগ (arthritis), যা মূলত মেরুদণ্ড এবং শরীরের বড় বড় জয়েন্টগুলোকে আক্রান্ত করে। এটি প্রাথমিকভাবে পিঠের নীচের অংশে ব্যথার মাধ্যমে শুরু হয় এবং কখনও কখনও নিতম্বে ব্যথা ও পিঠে কঠিনতা বা অস্বস্তি দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলি (vertebrae) একত্রে জোড়া লেগে (fusion) কঠিন ও অনমনীয় হয়ে যেতে পারে, যাকে অ্যাঙ্কাইলোসিস (ankylosis) বলা হয়।
রোগটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:
এটি মূলত পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়— নারীদের তুলনায় পুরুষদের আক্রান্তের সংখ্যা দুই থেকে তিন গুণ বেশি। এটি সাধারণত কৈশোর-পরবর্তী বা তারুণ্যের শুরুতেই শুরু হয়। নারীদের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের চেয়ে শরীরের অন্যান্য জয়েন্টগুলো বেশি আক্রান্ত হয়। যদিও সব বয়সের মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে, সবচেয়ে সাধারণত এটি ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়।
সম্ভাব্য কারণ:
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ (autoimmune disease) হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ রোগীর নিজের ইমিউন সিস্টেম শরীরের স্বাভাবিক কোষ ও জয়েন্টগুলিকে আক্রমণ করে। জেনেটিক (আনুবংশিক) উপাদান এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। অধিকাংশ আক্রান্ত রোগীর দেহে HLA-B27 নামক একটি জিন পাওয়া যায়। সম্প্রতি আরও দু’টি জিন (ARTS1 ও IL23R) শনাক্ত হয়েছে, যেগুলি রোগের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।
রোগ নির্ণয়:
এই রোগের সনাক্তকরণ নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সাহায্য করে:
* HLA-B27 অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি
* রক্তে CRP (C-reactive protein) এবং ESR (Erythrocyte Sedimentation Rate) এর মাত্রা বৃদ্ধি
* সংশ্লিষ্ট উপসর্গ এবং রোগের ইতিহাস
উপসর্গসমূহ:
কোমর ও নিতম্বে বেদনাদায়ক শক্তভাব, যা সকালে বা দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর বেশি হয়
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যথা উপরের দিকে মেরুদণ্ডে এবং অন্যান্য জয়েন্টে (হাঁটু, পা, কাঁধ) ছড়াতে পারে
পিঠ বাঁকাতে অসুবিধা ও গতিশীলতার হ্রাস
রোগ অগ্রসর হলে মেরুদণ্ড একেবারে কুঁজো হয়ে যায় এবং বুকে প্রসারণের ক্ষমতা হ্রাস পায়
ক্লান্তি, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন হ্রাস, চোখে প্রদাহ (iritis), এবং অন্ত্রে জ্বালা বা প্রদাহও দেখা দিতে পারে।
এই রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত বরুণের চিকিৎসক রিউম্যাটোলজিস্ট অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় আজকাল ডট ইনের মুখোমুখি হয়ে জানান, এই রোগটি দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল, তাই চিকিৎসার নির্দিষ্ট সময় বলা যায় না। তবে, বেশিরভাগ রোগী চার সপ্তাহের মধ্যেই ব্যথা কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখতে পান। চিকিৎসার সময়কাল রোগভেদে পরিবর্তিত হয় এবং এটি নির্ভর করে:
* রোগ কতদিন ধরে রয়েছে
* টিস্যু ক্ষয় ও জয়েন্ট ফিউশনের মাত্রা
* রোগীর বয়স ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য
* পূর্বে নেওয়া ও চলমান ওষুধের উপর
চিকিৎসক এই রোগ নিয়ে সতর্কতা বার্তা দিতে গিয়ে বলেন, "রোগ যত দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হবে, তত বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। তাই যে কোনও ব্যথা বা কুঁজো ভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি"।
বরুণ আজকাল ডট ইনের মুখোমুখি হয়ে বলেন, "২০০০ সালে আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম এই রোগে। তারপরে বহু জায়গায় বহু চিকিৎসা করায় এবং চিকিৎসা চলাকালীন আমি সম্পূর্ণ ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছিলাম। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে আমি সত্যিই সুস্থ হয়ে ফিরবো। আত্মহত্যা করব বলে ভেবে নিয়েছিলাম, হয়ে পরেছিলাম বিছনায় শয্যাশায়ী, হামাগুড়ি দিয়ে পর্যন্ত বাথরুমে যেতে হতো। ২০২৩ সাল আমার নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। দক্ষিণ ভারতেও চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম সেখানেও সদ উত্তর দিতে পারিনি বা সঠিক চিকিৎসা করতে পারিনি।"
তিনি আরও বলেন, "বহু জায়গায় বহু চিকিৎসার পর অবশেষে ২০২৪ সালে চিকিৎসক অর্ঘ চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়ে আমি সুস্থ হয়েছি। মূলত তিনি চারটে ইঞ্জেকশন আমার উপর প্রয়োগ করেছেন যার জন্য আমি সুস্থ হয়েছি এবং প্রায় দু বছর হতে এলো আমি এখন পূর্ণ সুস্থ তবে মৌখিক ওষুধ চলছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন এখন এই ওষুধ খেয়ে খেয়ে যেতে হবে এবং চিকিৎসাধীন থাকতে হবে। আমি এখন শুধু সোজা হয়ে হাঁটতে নয় দৌড়াতে পর্যন্ত পারি এবং বিভিন্ন জায়গায় আবার পূর্বের মতো ট্রাভেল করে বেড়াচ্ছি কাজের সূত্রে। যা সম্ভব হয়েছে চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়ের জন্যই"।