• স্যরের ‘কর্তব্যটুকু’তে জেলে নৌকো থেকে IIT-শিক্ষক পদে
    এই সময় | ১৮ আগস্ট ২০২৫
  • সোমনাথ মাইতি, কাঁথি

    বসন্ত কুমার ঘড়াই যখন খুঁজতে খুঁজতে তার দাওয়ায় পৌঁছন, সে তখন বাড়ি নেই। মাছ ধরতে বাবার সঙ্গে সমুদ্রে গিয়েছে। সালটা ২০০৮। সে বছরই ৮৬.২৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে যাদব মাঝি। তার আগের বছর নয়াপুট সুধীরচন্দ্র হাইস্কুলে হেডমাস্টার হিসেবে যোগ দিয়েছেন বসন্ত।

    স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পঠনপাঠনের সূত্রপাত তাঁরই উদ্যোগে। সেখানে কি না মাধ্যমিকে অত ভালো নম্বর পাওয়া ছেলেটাই বেপাত্তা! একে ওকে জিজ্ঞাসা করে যাদবের মাছ ধরতে যাওয়ার কথা জানতে পেরে বসন্ত পৌঁছে যান তার দাওয়ায়। বাড়ির লোক জানান, বাবা লঙ্কেশ্বর মাঝির সঙ্গে সমুদ্রে গিয়েছে যাদব। কখন ফিরবে, ঠিক নেই। দাওয়ায় বসেই ছাত্রের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শুরু করেন প্রধান শিক্ষক।

    তার পরের অধ্যায়টা অধ্যবসায়, ধৈর্য, জেদ, স্বপ্ন আর পরিশ্রমের। সে পর্বের বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার আগে জানানো যাক, সংসারের হাল ধরতে বইখাতা ফেলে সমুদ্রে যাওয়া সেই যাদব ক্যানাডায় উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরছেন আজ, সোমবার। আর সেপ্টেম্বরে আইআইটি–ধানবাদে প্রফেসর পদে যোগ দেওয়ার কথা তাঁর। নেপথ্যের ‘কারিগর’ বসন্ত মাস্টারমশাই খুশি তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও এমন যাদব তৈরিতে ব্যস্ত তিনি। ছাত্রকে তিনি শুধু বলেছেন — ‘যে দিন কাজে যোগ দিবি, সে দিন স্কুলের ১২০০ জনের সঙ্গে বিরিয়ানি খাব।’

    কাঁথি–১ ব্লকের নয়াপুট অঞ্চলের রঘুসর্দারবাড় জালপাই গ্রামে বাড়ি যাদবের। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে পরিবারে তৃতীয় সন্তান সে। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসার চলত লঙ্কেশ্বরের মাছ ধরার সামান্য আয়ে। এলাকায় স্কুল বলতে ওই নয়াপুট সুধীরচন্দ্র হাইস্কুল। সেখান থেকেই ২০০৮–এ মাধ্যমিক পাশ করেন যাদব। তারপরে ‘ড্রপ আউট’–এর তালিকায় আরও একটা নাম হিসেবে যুক্ত হওয়ার ভবিতব্য মেনে নিয়ে মাছ ধরার কাজে নেমে পড়েন।

    যে ভবিতব্যকে বদলে দেন বসন্ত। ‘রিওয়াইন্ড’ করে ১৭ বছর আগে দাওয়ায় বসে অপেক্ষার দিনটায় ফিরে যান প্রৌঢ়। বলেন, ‘যাদবের বাবার সঙ্গে কথা বলে ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নিই। স্কুলে তখনও হস্টেল তৈরি হয়নি। কাঁথিতে আমার বাড়িরই দোতলায় ওর থাকা–খাওয়া–লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলাম। দু’বছর সেখানে থেকে ৮৪.৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল যাদব। আমার এই বাড়ির পাশেই একটা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম আছে। সেখানকার মহারাজদের সঙ্গে কথা বলে বেলুড় বিদ্যামন্দিরে কেমিস্ট্রি অনার্সে যাদবের ভর্তির ব্যবস্থা করা হলো।’

    ২০১৩–য় বেলুড় থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে ‘গেট’ (দ্য গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং)–এ সফল হয়ে আইআইটি–বম্বেয় এমএসসি–তে ভর্তি হন যাদব। তাঁর মেধা সেখানকারঅধ্যাপকদের নজর কাড়ে। প্রফেসররা বসন্তকে ডেকে পাঠিয়ে জানান, ছাত্রকে বিদেশে পাঠাতে চান তাঁরা। তাঁদেরই সহযোগিতায় ক্যানাডায় কুইন’স ইউনিভার্সিটিতে জৈব রসায়নে ডক্টরেটের সুযোগ পান কাঁথির প্রত্যন্ত গ্রামের মৎস্যজীবী পরিবারের ছেলে। সেই যাওয়া। তারপরে একেবারে ইউএসএ–র ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভ্যানিয়া থেকে পোস্ট ডক্টরেট করে ফিরছেন যাদব। ইতিমধ্যে তাঁর ঝুলিতে দেশি–বিদেশি একাধিক পুরস্কার।

    এ জন্য বসন্ত মাস্টারমশাই তো বটেই, আইআইটি–র প্রফেসর থেকে শুরু করে পাশে দাঁড়ানো সক্কলের সহযোগিতার কথা জানাচ্ছেন তিনি। সেপ্টেম্বরে ধানবাদে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তার আগে কানপুর, হায়দরাবাদ ও মাদ্রাজ আইআইটি–তে ইন্টারভিউ দেবেন তিনি। এই তিন জায়গা থেকেই ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়েছে তাঁকে।

    তবে ছেলের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি বাবা লঙ্কেশ্বর। গত বছর মারা গিয়েছেন তিনি। মা স্বর্ণময়ী বলেন, ‘ছেলে বরাবর পড়াশোনা করতে ভালোবাসত। মাছ ধরার নৌকোতেও বই নিয়ে যেত। সকলের চেষ্টায় ও আজ সফল। শুধু ওর বাবাই দেখতে পেলেন না।’

    আর বসন্ত? সেই ২০০৭ থেকে এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোয় নিরলস তিনি। তখনও মাধ্যমিক পেরিয়ে এইচএস পড়তে কাঁথি শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না ছাত্রছাত্রীদের। ২০০৮–এ স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক চালু দিয়ে শুরু বসন্তের পথচলা। তার পরে কী ভাবে তিনি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, সে কথা চাক্ষুষ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্মার্ট ক্লাস থেকে পড়ুয়াদের বায়োমেট্রিক হাজিরার পদ্ধতি চালু হয়েছে তাঁর চেষ্টায়। ২০০৮–এ এইচএসে বিজ্ঞান শাখা চালুর সময়ে স্টুডেন্ট ছিল মাত্র ১১ জন। এখন সংখ্যাটা শতাধিক। সব মিলিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি, এখন ১২০০ জন ওই স্কুলে পড়াশোনা করে।

    পাশাপাশি চলেছে বসন্তের ‘যাদব’ তৈরির চেষ্টা। এঁদের একজন পিন্টু মাইতি। আর এক মৎস্যজীবী পরিবারের এই ছেলে প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে এখন আইআইটি–খড়্গপুরে গবেষণা করছেন। যেমন বাজকুলের দিনমজুর পরিবারের সন্তান বুদ্ধদেব মণ্ডল। তাঁকেও আইআইটি–খড়্গপুরে এমটেক–এর পথে এগিয়ে দিয়েছেন মাস্টারমশাই।

    দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের সাফল্যের পথে এগিয়ে দিয়ে কেমন লাগে স্যর? বসন্তর জবাব, ‘ওরা নিজেদের মেধা, দক্ষতা, চেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে সফল হয়েছে। আমি শুধু রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছি। একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্তব্যটুকু করেছি মাত্র।’

  • Link to this news (এই সময়)