শাঁখের করাত একেই বলে! অথবা ‘আগালে নির্বংশের ব্যাটা, পিছলে আঁটকুড়োর ব্যাটা’! কিংবা ধর্মসঙ্কট! বাংলার শাসকদলের নেতাদের একাংশের এখন তেমনই অবস্থা বটে।
ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চিরশত্রু মোহনবাগানকে হারিয়ে টগবগ করছে ইস্টবেঙ্গল। বুধবার সেমিফাইনালে যুবভারতীতে লাল-হলুদ মুখোমুখি হবে ডায়মন্ড হারবার এফসি-র। যে ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকের নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কোন অভিষেক? যিনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। সেই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক তৃণমূল নেতারা কার হয়ে গলা ফাটাবেন? কার জয় চাইবেন? মস্তিষ্কের নির্দেশে চলবেন না কি হৃদয়ের আবেগে?
উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে কট্টর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তৃণমূল নেতাদের বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মস্তিষ্ক বনাম হৃদয়ের যুদ্ধ একটা হচ্ছে বটে। কেউ এই প্রসঙ্গে ঢুকতেই চান না। ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হাজার হোক। কেউ অবলীলায় জানিয়ে দিলেন, অভিষেক তাঁদের নেতা হলেও তাঁরা কখনও ডায়মন্ড হারবারের জয় চাইতে পারবেন না। তাঁরা ইস্টবেঙ্গল ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কেউ আবার জবাব দিতে গিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘বড় বিড়ম্বনার প্রশ্ন!’’
প্রথম উদাহরণ: শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। কট্টরতম ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। গত রবিবার মাঠে গিয়ে ডার্বি দেখেছেন। জেতার পর বেরিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের মরোক্কান স্ট্রাইকার হামিদ আহদাত ‘ম্যাচ ফিট’ কি না, যথার্থ ফুটবলবোদ্ধার মতো সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। নিজের মতো করে ‘ম্যাচের সেরা’ বেছেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডার আনোয়ার আলিকে। দেখা গেল, ইস্টবেঙ্গল-ডায়মন্ড হারবার ম্যাচে সমর্থন নিয়ে ব্রাত্যের ডিফেন্সও আনোয়ারের মতোই। মোবাইলে প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ‘নো রিঅ্যাকশন’।
দ্বিতীয়: রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিক। আপাদমস্তক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। ইস্টবেঙ্গল জিতলে একদা নৈহাটির রাস্তায় নেমে লাল-হলুদ পতাকা ওড়াতেন। তবে তিনি ব্রাত্যের মতো ‘রক্ষণ’ আগলাননি। অভিষেককে শুভেচ্ছা জানালেও বুধবারের ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকেই সমর্থন করার কথা ঘোষণা করেছেন। পার্থ বলেছেন, ‘‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে অভিষেক ডায়মন্ড হারবার এফসি গড়েছেন। আমি তাঁর সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। শুধু বলব, ডায়মন্ড হারবার সব দলের বিরুদ্ধে জিতুক। শুধু ইস্টবেঙ্গল ছাড়া।’’
তৃতীয়: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। তিনিও কিন্তু বুধবার লাল-হলুদের জয় চাইছেন। ডায়মন্ড হারবার ‘অভিষেকের ক্লাব’ হলেও তিনি ইস্টবেঙ্গলকেই সমর্থন করবেন। গৌতমের কথায়, ‘‘আমি ছোটবেলা থেকেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থক।’’ সঙ্গে ছোট আউটসাইড ডজ, ‘‘আর খেলার মধ্যে অন্য কিছু না আনাই ভাল।’’
তৃণমূলের মুখপাত্র তথা কলকাতা পুরসভার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তীও ব্রাত্য, পার্থ, গৌতমদের মতো ইস্টবেঙ্গলের ঘোর সমর্থক। ক্লাবের যে কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। আবার একইসঙ্গে ‘ক্যামাক স্ট্রিট-ঘনিষ্ঠ’ বলেও তৃণমূলের অন্দরে পরিচিত। সেই অরূপও মন-মাথার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে নিয়েছেন। মঙ্গলবার তিনি বললেন, ‘‘বছরে ৩৬৪ দিন আমার নেতা অভিষেক। আমি ‘এবি’-র (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম-পদবির ইংরাজি আদ্যক্ষর মিলিয়ে দলে তাঁকে ওই নামেই ডাকা হয়) অনুগামী। কিন্তু ফুটবলে মুখোমুখি হলে আমি লাল-হলুদেই থাকব।’’
তৃণমূলের তরুণ মুখপাত্র কোহিনূর মজুমদার সদ্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তিনি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হলেও তাঁর স্ত্রী মোহনবাগানী। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে তৃণমূল নেতা তথা মোহনবাগানের অন্যতম কর্তা কুণাল ঘোষ লিখেছিলেন, ‘শ্রীমান কোহিনূরের বিয়ে। আশার কথা, শ্রীমতী মোহনবাগান সমর্থক। আশা করি শ্রীমান বিপথ থেকে ফিরবে। শুভেচ্ছা।’ কুণাল চেয়েছিলেন, বিয়ের পরে ‘সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য’ লাইন ধরে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনপথে ফিরুন কোহিনূর। কিন্তু তৃণমূলে কুণালের সহকর্মী রবিবার মোহনবাগানকে হারানোর পরে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করে একটি কোহিনূরের মতোই হীরকখচিত পোস্ট করেছেন, ‘২-১ এ হারিয়ে অষ্টমঙ্গলার পর বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছি। পরের উইকএন্ডে ডুরান্ড নিয়ে ফিরব।’ অষ্টমঙ্গলার পর এই মঙ্গলেও তিনি অনড়। বুধবারের ম্যাচ নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা রাখেননি। স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার আদর্শ। কিন্তু ফুটবলে আমি ইস্টবেঙ্গলেরই সমর্থক।’’
ডায়মন্ড হারবার ভাল দল গড়েছে। গ্রুপ পর্বে মোহনবাগানের কাছে পাঁচ গোল খেলেও পয়েন্টের বিচারে নকআউটে উঠেছে তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে জামশেদপুরে গিয়ে জামশেদপুর এফসি-কে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে অভিষেকের দল। টিমে রয়েছেন নামী বিদেশি খেলোয়াড়। দায়িত্বে কিবু ভিকুনার মতো প্রাজ্ঞ কোচ। ডায়মন্ড হারবার এফসি-কে হাল্কা ভাবে নিচ্ছে না ইস্টবেঙ্গলও। বস্তুত, রবিবারের ডার্বিতে হারের পর মোহনবাগান সমর্থক তৃণমূল নেতারা বুধবার ডায়মন্ড হারবারের জন্য গলা ফাটাতে প্রস্তুত হচ্ছেন। যেমন কুণাল। কিন্তু গ্রুপ পর্বে মোহনবাগান-ডায়মন্ড হারবার ম্যাচে তিনি কোন দিকে ছিলেন? জবাব এল, ‘‘মোহনবাগানকেই সমর্থন করেছি। মোহনবাগান খেললে অন্য কিছুর প্রশ্নই ওঠে না। তবে উল্টো দিকে ক্যাপ্টেনের টিম ছিল। পাঁচ গোলটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে। অতগুলো না হলেই পারত।’’
বুধবারের স্লোগান নিয়েও কুণালের কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই— ‘‘বুধবার জয় ডায়মন্ড।’’ তাতে অবশ্য দমছেন না ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তৃণমূল নেতারা। তাঁরা বলছেন, ‘‘খেলা হবে!’’