শিলাদিত্য সাহা
দীর্ঘ ১১ বছরের অপেক্ষার অবসান। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টাইগার রিজ়ার্ভ হিসেবে অচিরেই আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে সুন্দরবন!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যে থাকা বিশ্বের একমাত্র বাঘের জঙ্গল তো গত বছরই তার যাত্রা শুরুর ৫০ বছর পূর্তি পালন করেছে। তার আবার আত্মপ্রকাশ কেন। ঘটনা হলো, এখনও পর্যন্ত বাদাবনে বাঘের যে আবাস ছিল ২,৫৮৫ বর্গ কিলোমিটার, এ বার সেটাই ১,০৪৪ বেড়ে হতে চলেছে ৩,৬২৯ বর্গ কিমি।
সেক্ষেত্রে গোটা দেশে এর থেকে বড় বাঘের জঙ্গল বলতে থাকবে শুধুমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুন সাগর–শ্রীশৈলম টাইগার রিজ়ার্ভ (৩,৭২৭ বর্গ কিমি)। সোমবার নয়াদিল্লিতে ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ডলাইফের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে পাঠানো সুন্দরবন টাইগার রিজ়ার্ভের এলাকা সম্প্রসারণের প্রস্তাবটি সরকারি ভাবে সিলমোহর পেয়েছে। এ বার রাজ্য সরকার নোটিফিকেশন জারি করে জানাবে, বর্ধিত এলাকার কতটা কোর আর কতটা বাফার হিসেবে চিহ্নিত হবে।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরবন টাইগার রিজ়ার্ভে (এসটিআর) জুড়তে চলেছে বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগনা বনবিভাগের হাতে থাকা তিনটি রেঞ্জ — রামগঙ্গা, রায়দিঘি ও মাতলা। এখন এসটিআর–এর হাতে রয়েছে চারটি রেঞ্জ — জাতীয় উদ্যান (পূর্ব), জাতীয় উদ্যান (পশ্চিম), সজনেখালি এবং বসিরহাট।
১,০৪৪ বর্গ কিমির নতুন তিনটি রেঞ্জ ‘বাফার এরিয়া’ হিসেবে এসটিআর–এ জুড়বে বলে রাজ্য বন দপ্তর সূত্রে খবর। রামগঙ্গা, রায়দিঘি ও মাতলা রেঞ্জের জঙ্গলের বাঘদের ধরেই সুন্দরবনে বাঘের মোট সংখ্যা ১০১।
অথচ এই তিনটি রেঞ্জ এতদিন টাইগার রিজ়ার্ভ এলাকার বাইরে থাকার ফলে এখানে একইরকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বনকর্মীরা তাঁদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা পেতেন না। সম্প্রসারণে শুধু বনকর্মীদের নয়, বাঘ সংরক্ষণে ‘সায়েন্টিফিক ম্যানজেমেন্ট’–এরও উন্নতি হবে বলে মনে করছেন বনকর্তারা।
সুন্দরবন টাইগার রিজ়ার্ভ সম্প্রসারণের প্রথম প্রস্তাবটি জমা পড়েছিল ২০১৪ নাগাদ। রাজ্যের ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড সেই প্রস্তাবে সায় দেয় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। তার কয়েক মাসের মধ্যেই রাজ্য সরকার এবং জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (এনটিসিএ) সবুজ সঙ্কেত দেয় এসটিআর সম্প্রসারণে। বাকি ছিল শুধুমাত্র কেন্দ্রের সম্মতি।
কারণ, দেশের যে কোনও সংরক্ষিত অরণ্যের পরিধি পাল্টাতে গেলে ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ডলাইফ–এর ছাড়পত্র প্রয়োজন। সূত্রের খবর, অগস্টের শুরুতে রাজ্য সরকার এই সম্প্রসারণ প্রস্তাব বোর্ডের কাছে পাঠায়।
সোমবার সম্মতি দেওয়ার পরে বোর্ডের এক সদস্য বলেন, ‘এ বার এনটিসিএ–র সঙ্গে পরামর্শ করে রাজ্য সরকার স্থির করবে, নতুন সংযোজিত তিনটি রেঞ্জের প্রায় ১১০০ বর্গ কিমি এলাকার কতটা কোর, কতটা বাফার হবে। তার পরে ওরা নোটিফিকেশন জারি করলেই নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করবে এসটিআর।’
শুধুই কি আত্মপ্রকাশ? মহারাষ্ট্রের মেলঘাট, ওডিশার সিমলিপাল, অসমের মানস আর ছত্তিসগড়ের ইন্দ্রাবতী টাইগার রিজ়ার্ভকে পিছনে ফেলে একধাক্কায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঘবন হিসেবে উঠে আসছে সুন্দরবন। জানা যাচ্ছে, টাইগার রিজ়ার্ভ এলাকায় অন্তর্ভুক্তির ফলে রামগঙ্গা, রায়দিঘি ও মাতলা রেঞ্জের বনকর্মীরা এ বার বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন।
সেখানে তাঁরা শুধু বাঘ সংরক্ষণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের ব্যবহার শিখবেন এমন নয়। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন–সহ টাইগার রিজ়ার্ভ এলাকায় কার্যকর বাকি আইন এবং তার ব্যবহারও শেখানো হবে সবাইকে। দেশের বাকি টাইগার রিজ়ার্ভের কর্মীদের মতো তাঁরাও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য বিশেষ ভাতা (রিস্ক অ্যালাওয়েন্স) পাবেন। বর্ধিত এলাকার জন্য কেন্দ্রের আর্থিক অনুমোদনও বেশি পাবে সুন্দরবন। এই পরিবর্তন বনকর্মীদের মনোবল ও উৎসাহ বাড়াবে — মনে করছেন বনকর্তারা।
সুন্দরবনের প্রাক্তন ফিল্ড ডিরেক্টর তথা বঙ্গের প্রাক্তন হেড অফ ফরেস্ট সৌমিত্র দাশগুপ্তর কথায়, ‘কোর হোক বা বাফার, যখনই বাঘের জঙ্গলে ঘেরা ওই তিনটি রেঞ্জ সরাসরি ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যাবিট্যাট এরিয়ার মধ্যে ঢুকবে, সেখানে বাঘ ও অন্য পশুপাখি সংরক্ষণের কাজে আমূল বদল আসবে। এমন অনেক আইনি সুবিধা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জায়গা রয়েছে, যা শুধুমাত্র টাইগার রিজ়ার্ভ এলাকাতেই সম্ভব। রামগঙ্গা, রায়দিঘি আর মাতলার বনকর্মীরা এ বার যোগ্য সুযোগসুবিধা পাবেন। লোকালয়ে বাঘ আসার ঘটনাও এ বার কমবে বলে আশা করছি।’
রাজ্যের প্রাক্তন প্রধান বনকর্তা প্রদীপ ব্যাসের কথায়, ‘বহুদিনের একটা স্বপ্ন দিনের আলো দেখতে চলেছে। বাঘ সংরক্ষণের প্রোটোকল যথাযথ মেনে চলতে হবে আমাদের। সুন্দরবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এটাই সুযোগ।’
শুধুই কি বাঘ সংরক্ষণ? সুন্দরবনের সম্প্রসারণে ভোল পাল্টাতে পারে স্থানীয় অর্থনীতিরও। কারণ এ বার নতুন সংযোজিত এলাকার জন্যও সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) খাতে অর্থ পেতে পারবেন এসটিআর কর্তৃপক্ষ। ২০০৬ সালে দেশজুড়ে গঠিত ‘টাইগার রিজ়ার্ভ ফাউন্ডেশন’–এর মাধ্যমে বেসরকারি সাহায্যও পেতে পারে বাদাবনের বাঘবন, যা পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য জরুরি।
তবে সবার ওপরে যে রয়্যাল বেঙ্গলই, মনে করিয়ে দিয়েছেন সুন্দরবনে কাজ করা বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডু। তাঁর কথায়, ‘এ বার সুন্দরবনের সব বাঘ ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ারভেশন প্রোটোকলের আওতায় আসবে। এই সম্প্রসারণে যাতে সংরক্ষণের কাজ ঠিক ভাবে হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বটা কিন্তু বিরাট।’