উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রায় সাড়ে তিন মাস অতিক্রান্ত। অথচ রাজ্যের সরকার-নিয়ন্ত্রিত কলেজগুলিতে এখনও শুরু হয়নি ভর্তি প্রক্রিয়া। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-সহ হাতে-গোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথারীতি ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বাকি প্রায় ৪৬০টি কলেজে থমকে আছে ভর্তি প্রক্রিয়া। চূড়ান্ত হতাশায় ভুগছে পড়ুয়ারা। উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের। উৎকণ্ঠিত কলেজ কর্তৃপক্ষের পড়ুয়া হারানোর আশঙ্কাও ক্রমশ বাড়ছে।
এমনিতে রাজ্যের সরকার-পোষিত কলেজগুলিতে ভর্তির হার উদ্বেগজনক ভাবে কমছে। তবে এ বারের পরিস্থিতি নজিরবিহীন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের ৪১ দিনের মাথায় শুরু হয়েছিল কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন জমা নেওয়া। গত ১৮ জুন থেকে শুরু হয়ে কয়েক দফায় সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ জুলাই শেষ হয় আবেদন পর্ব। উচ্চ শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা যায়, ৩০ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন লাখ ৫৯ হাজার ১১৪টি আবেদন জমা পড়েছে। যদিও গত বছরে রাজ্যের সরকার-নিয়ন্ত্রিত কলেজগুলিতে মোট আসন ছিল নয় লক্ষ ৪৬ হাজারের বেশি।
এই বিপুল সংখ্যক ফাঁকা আসনের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা। নদিয়ার কলেজগুলিতেও একই ছবি। বেশির ভাগ কলেজেই ভর্তির আবেদন আসন সংখ্যার অর্ধেকও ছোঁয়নি। কোথাও আরও কম। অধ্যক্ষেরা জানাচ্ছেন, এই বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কম ছিল। ফলে অন্য বারের তুলনায় এ বার কলেজে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কম হবে, সেটা হিসাবের মধ্যেই ছিল। কিন্তু তার মধ্যে সংরক্ষণ নিয়ে আইনি জটে তা চরম আকার নিয়েছে। দফায় দফায় আবেদন করার সময়সীমা বৃদ্ধি করেও বিশেষ লাভ হয়নি।
নদিয়া জেলার উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহর থেকে গ্রাম সব কলেজেই একই চিত্র। ভর্তি সংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য জানান দিচ্ছে যে পড়ুয়া, অভিভাবক এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ কতটা যথার্থ। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে মোট আসন সাত হাজারের বেশি। কিন্ত প্রথম পছন্দ হিসাবে নির্বাচন করেছেন মাত্র ৯৬৯ জন। কিংবা আসাননগর কলেজে আসন সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। প্রথম পছন্দ করেছেন মাত্র ৬০ জন আবেদনকারী।
এই প্রসঙ্গে বুধবার চাকদহ কলেজের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক পরিতোষ সরকার বলেন, “ভর্তিতে যত দেরি হবে, ততই পড়ুয়ারা বেসরকারি কলেজ বা অন্যান্য দিকে চলে যাবে। আমাদের কলেজগুলিতে ভর্তি আরও কমবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তারা অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। যাদের ক্ষমতা নেই, সেই সব পড়ুয়ারা নিরুপায়। অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তাঁরা বার বার খবর নিচ্ছেন। কিন্তু যতক্ষণ না নির্দেশ পাচ্ছি, আমাদেরও করণীয় কিছু নেই।”
রানাঘাট কলেজের অধ্যক্ষ অরূপকুমার মাইতির আশঙ্কা, সব মিলিয়ে এ বার গত দশ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে কলেজগুলিতে। তিনি বলেন, “আমাদের এই সব অঞ্চলে একটা বড় সংখ্যক পড়ুয়া খুব দুর্বল আর্থিক অবস্থায় লেখাপড়া করে। তারা আগ্রহ হারাচ্ছে। কেউ বা কাজে ঢুকে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে বা অন্য পেশাদার কোর্সে ভর্তি হচ্ছে।”
চাপড়া বাঙ্গালঝি কলেজের অধ্যক্ষ নীলাঞ্জন গুহের বক্তব্য, “সরকার পরিচালিত কেন্দ্রীয় পোর্টালে কলেজের কোনও ভূমিকা থাকে না। আমরা চাইছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জটিলতা কেটে গিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাতে পড়ুয়াদের সুবিধা হবে। অন্যথায় ওদের পড়াশোনার যতটা সময় পাওয়ার কথা, সেটা ওরা পাবে না। আমাদের এখানে যা আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাতে অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। বড় জোর পঞ্চাশ শতাংশ আবেদন হয়েছে।”
নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ স্বপনকুমার রায় বলেন, “কলেজে এখন অনেক আসন, যা পুরো ভর্তি হয় না। এ বারে যা অবস্থা তাতে পড়ুয়াদের অপেক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমরা প্রস্তুত আছি। সরকারের সবুজ সঙ্কেত পেলেই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।” আসাননগরের মদনমোহন তর্কালঙ্কার কলেজের অধ্যক্ষ অশোককুমার দাসের কথায় উদ্বেগ স্পষ্ট— “এখনও পর্যন্ত আবেদন যা হয়েছে তা মোট আসন সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। তার মধ্যে মাত্র ৬০টি আবেদন প্রথম পছন্দের। শেষ পর্যন্ত কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা বুঝতে পারছি না।”