বাংলার লোকসংস্কৃতির চারণভূমি বললেই উত্তরবঙ্গের নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়। এখানকার মাটির গন্ধ, আর প্রজন্মের পর-প্রজন্ম ধরে চলে আসা রীতিনীতি যেন মিশে আছে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। সাহিত্যিক দেবেশ রায়ও এই উত্তরবঙ্গের লোকাচারকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে। যেমন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে আমরা পাই উত্তরের লৌকিক দেবী তিস্তাবুড়ির কথা। এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।
ফুটিফাটা শুষ্ক জমিতে যত ধুলো ওড়ে, পাল্লা দিয়ে কৃষকের চোখে উদ্বেগের রেখাও গভীর হয়। আর ঠিক এই সময়, উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলিতে দেখা যায় ব্যাঙের বিয়ের প্রস্তুতি। যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই আছে শুধু বিশ্বাস। শুধু লোককথা নয়— এ এক অলিখিত চুক্তি। অদৃশ্য বন্ধন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের।
লোকাচার মতে, ব্যাঙ হল বর্ষা দেবতার একটি পছন্দের প্রাণী। আর ব্যাঙের ডাক নাকি মেঘকে আহ্বান করে নিয়ে আসে বৃষ্টি। তাই বৃষ্টির আশায় গ্রামের সমস্ত ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়ে দু’টি ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করেন। ঠিক যেমন করে মানুষের বিয়ে হয়— আলো, সাজসজ্জা, উপঢৌকন, সিঁদুর এমনকী বরযাত্রীরাও থাকেন। সঙ্গে থাকে খাওয়াদাওয়া, ঢাকঢোল। সবশেষে আসে প্লেটে পান-সুপারি। আর সেই হাসি-আনন্দের মাঝে থাকে একটাই চাওয়া। আকাশ থেকে জল নামুক, শুষ্ক মাটি ভিজে যাক। তবে যতই হাসি ঠাট্টার আচার-অনুষ্ঠান হোক, এর ভিতরে লুকিয়ে আছে গ্রামীণ কৃষকের অসহায়তা ও হাহাকার।
এই বিয়ে কি শুধুই বৃষ্টি নিয়ে আসে? মানুষকেও কাছে আনে। উত্তরের গ্রামীণ জীবনে কৃষিভিত্তিক যে সব লোকাচার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, তার মধ্যে ব্যাঙের বিয়ে অন্যতম। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং মালদহের কিছু গ্রামে এখনও এই রীতি টিকে আছে। এছাড়াও বর্ধমান, দক্ষিণ দিনাজপুর, ওড়িশার কিছু অঞ্চল এবং আসামের বহু গ্রামেও এই প্রথা আছে।
ব্যাঙের বিয়ে কেবল একটি লোকাচারই নয়, এটি উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির জীবন্ত আখ্যান। এখানে আছে পরিবেশ নির্ভরশীল কৃষিজীবনের ছাপ, বিশ্বাসের সুর ও বিভিন্ন গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মিলনের ছবি। যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি একই উৎসবে বাঁধা পড়ে। বিয়ের ক’দিন পরেই যদি বৃষ্টি নামে, গ্রামের মানুষ মনে করে ব্যাঙের বিয়ের ফলেই বৃষ্টি এল। যদি বৃষ্টি না-ও নামে, তবু অনুষ্ঠানটা, এই ক্ষণিকের আনন্দটুকুই থেকে যায় স্মৃতিতে। তাতে মিলেমিশে যায় সব ধর্মের মানুষ, ভেসে আসে সম্প্রীতির বার্তা। যুগে-যুগে মানুষের আচার পালনের ভঙ্গি বদলায়, বদলায় সময়, যুক্তি-তর্কের মাপকাঠিও বদলে যায়। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু পাওয়ার সেই চিরন্তন আকুলতা বদলায় না। এই আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে পথ দেখায়, বাঁচিয়ে রাখে আর শেখায় আশা থাকলেই জীবন। জীবন থাকলেই আশা।