প্রসেনজিত্ সর্দার: জীবন জীবিকার জন্য সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে অসংখ্য মৎস্যজীবি বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। অসংখ্য মহিলা স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বিধবা পল্লি কিংবা বিধবা পাড়া তৈরী হয়েছে। এবার সুন্দরবন তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিংয়ে হাটপুকুরিয়া পঞ্চায়েত এলাকায় হদিশ পাওয়া গিয়েছে একাধিক ‘কিডনি’ পাড়ার।
যেখানে অসংখ্য মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ। শুধু ক্যানিং এলাকা বললে ভুল হবে ক্যানিং-সহ বাসন্তী,গোসাবা, ভাঙড়, জীবনলা এলাকাও রয়েছে এই তালিকায়। রয়েছে বারাইপুর থানা এলাকার বেলেগাছি, ঘোলা পঞ্চায়েত এলাকায় বহু মানুষ কিডনি বিক্রি করেছে বলে জানা যায়। এমনই বেলেগাছি পঞ্চায়েতের বাপি নাইয়া তিনিও কিডনি বিক্রি করেছেন। কিডনি বিক্রি করে পেয়েছেন ৭ লক্ষ টাকা।
এই কিডনি দেওয়ার কারণ তিনি দেনায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে বাড়ি থেকে তিন মাস ঘর ছাড়া ছিলেন। তারপরেও পাওনাদাররা তাকে ছাড়েনি। মারধর থেকে শুরু করে হেনস্তাও করেছিলেন। এরপর কিডনি বিক্রির জন্য দাড়িয়া হাটপুকুরিয়া ডেভিস এলাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে সাত লক্ষ টাকায় রফা হয়। এরপর সেই কিডনি দিতে চলে যান দমদমে নাগেরবাজার এলাকার আইএলএস নার্সিংহোমে। সেখানে ৯'দিন ছিলেন। আর সেখানেই সাত লক্ষ টাকা দালালরা হাতে দিয়ে দেয় বাপির স্ত্রী-র। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
আরও জানা যায়, দাঁড়িয়া পঞ্চায়েত এলাকায় আরও এক ব্যক্তি দেনার দায়ে কিডনি বিক্রি করতে কথা বলছেন ওই ডেভিস এলাকার এক দালাল চক্রের সঙ্গে। তিনি জানান, দাঁড়িয়ায় হাটপুকুর এলাকায় তিনজন দালাল আছে। প্রথমেই আমরা শুনিয়েছিলাম শ্যাম মোল্লার নাম। পরে আরও দুজনার নাম উঠে আসে মতিউর রহমান মোল্লা, আরেকজন খয়রুল মোল। এই তিনজন সক্রিয়ভাবে কিডনি পাচারের সঙ্গে যুক্ত বলে জানান ওই এলাকার বাসিন্দা আহমদ মোল্লার কাছে।
তিনি আরও বলেন, কিডনির জন্য অনেকেই দুটো তিনটে করে বিয়ে করছেন। শ্যাম মোল্লার তারও দুটো বিয়ে ও তার স্ত্রীদের কিডনি বিক্রি করে দিয়েছে এমনই অভিযোগ আহমেদ মোল্লার। একই দাবি করেছিল ক্যানিং পশ্চিমের বিধায়ক পরেশ রাম দাস। এ বিষয় নিয়ে ওই হাটপুকুরিয়ার পঞ্চায়েত অঞ্চল সভাপতি জালালুদ্দিন সদ্দারকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, বিষয়টি চিন্তার। দিন দিন কিডনি দেওয়ার প্রবলতা বেড়ে যাচ্ছে।
এলাকায় দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে অনেকে দালাল এই চক্রের মধ্যে তাদের প্রলোভন দেখে কিডনি বিক্রি করছে। এটা নিয়ে ওই তেঁতুলবেড়িয়া এলাকায় একটি ক্যাম্প তৈরি করা হবে। যেখানে ক্যানিং বিডিও, বিধায়করাও থাকছে। যাতে কিডনি আর না বিক্রি করে দেওয়া হয় তার জন্য প্রচার চালানো হবে। পাশাপাশি যারা এই কিডনি চক্রের সঙ্গে যুক্ত বা তিনজনের নাম উঠে আসছে। তাদেরকে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এই অঞ্চল সভাপতি।
ইতিমধ্যে বারাইপুর, ক্যানিং, বাসন্তী, গোসোবা, ভাঙ্গর, ক্যানিং পূর্ব এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই উদ্বিগ্ন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। জানা গিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে সক্রিয় রয়েছে কিডনি পাচার চক্র এবং দালাল। রয়েছে প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য একশ্রেণীর লোকজন। এদের ফাঁদে পা দিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে অনেকেই। মূলত দারিদ্রতা এবং লোভী মানুষজন এই সমস্ত দালালদের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি কিংবা দান করছেন।
কিডনি পাড়ায় পৌঁছে গিয়ে জানা গিয়েছে, এলাকায় কাজ নেই। সরকারীভাবে রেশনের চালটুকু ছাড়া আর কোনও অনুদান নেই। মাথা গোঁজার ঠাইও নেই ঠিকমতো। অনেকেই আবার প্রচুর টাকা দেনা করে ফেলেছেন। শোধ দিতে পারছেন না। এমন অবস্থায় কিডনি বিক্রি করেছেন অনেকেই। কিডনি বিক্রি করে অনেকে দেনা শোধ করেছেন। তৈরী করেছেন বসবাসের জন্য পাকা ঘর এবং আয়ের জন্য কিনে ফেলেছেন অটো, টোটো গাড়ি।
কিডনি বিক্রেতা ও তাঁদের পরিবারের দাবী, ‘এলাকায় কাজ নেই। ভীনরাজ্যে কাজে যেতে হয়। যা আয় হয়, অধিকাংশটাই খরচ হয়ে যায়। যার ফলে ধারদেনা করতে হয়। অনেকেই কিডনি বিক্রি করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চাইছেন। অনেকে সুযোগ পেয়ে অতিরিক্ত অর্থের লোভে প্রলোভনের ফাঁদে পা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে চলেছে, সুন্দরবন ব্যাঘ্র, বিধবা পাড়ার মতো অসংখ্য কিডনি পাড়া তৈরী হওয়ার আশাঙ্কা রয়েছে।