ধর্মে ধর্মে সংঘাত ভারতে কখনও হয়নি, এটা বলা যাবে না। তেমনই ভারতে হিন্দু, মুসলমানদের শান্তিতে পাশাপাশি থাকার এবং সহকর্মী হওয়ার ইতিহাসও ভোলা যাবে না বলে ফের সরব হলেন প্রবীণ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। হলেন এমন একটা সময়ে যখন সিনেমা থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করে বিভাজন সৃষ্টি চলছে।
আজ, শুক্রবার সল্টলেকে অমর্ত্য সেন রিসার্চ সেন্টারে ক্ষিতিমোহন সেনের 'ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা' বইটি প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্টের প্রকাশ করার কথা। বইটির ভূমিকায় আজকের ভারতে এ দেশের বহুত্ববাদী ভাবনাচিন্তার ধারাবাহিকতা ভেঙে অসহিষ্ণুতার প্রাধান্য নিয়ে অমর্ত্য আক্ষেপ করেছেন। নিজের জীবনে তাঁর দাদামশায় ক্ষিতিমোহন সেনের অসাম্প্রদায়িক মননের গভীর প্রভাবের কথা বার বার বলেছেন অমর্ত্য। ১৯৪৭ পরবর্তী গোষ্ঠী-হিংসা ধ্বস্ত ভারতে ক্ষিতিমোহন তাঁর লেখায় যুগ যুগ ধরে নানা পরিসরে হিন্দু, মুসলমানের সহযোগ, সমন্বয়ের কথা মেলে ধরেন। ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ নামে সেই বই প্রথম প্রকাশ করে বিশ্বভারতী। এ বইয়ের পুনর্মুদ্রণে বিশ্বভারতীর অনীহা নিয়েও প্রতীচী ট্রাস্ট প্রকাশিত বইয়ের ভূমিকায় অমর্ত্য দুঃখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বভারতীকে এখন কেন্দ্রীয় আদেশে চলতে হয়— তার মধ্যে রাজনীতির কোনও অংশ আছে কি না তা নির্ধারণ করা সহজ নয়!’
বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহের বইগুলির পুনরুজ্জীবনে বছর দশেক আগে অবশ্য বিশ্বভারতী ‘ভারত সংস্কৃতি’ বলে একটি গ্রন্থ সংকলন প্রকাশ করে। তাতে ক্ষিতিমোহনের ভারতের সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ এবং আরও কয়েকটি পুরনো বইয়ের সঙ্গে ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনাও অন্তর্ভুক্ত হয়। সংকলনটি ফের ছাপার কথা। তবে বিশ্বভারতীর বহু মূল্যবান বই, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশির ভাগ বইয়ের পুনর্মুদ্রণই সাম্প্রতিক অতীতে বন্ধ ছিল। এখন নতুন করে কিছু বই ছাপা হচ্ছে বলে জনসংযোগ আধিকারিক অতিগঘোষ জানান।
বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য তথা রবীন্দ্র সহচর ক্ষিতিমোহন হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের উদার বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের নানা দিক মেলে ধরেছিলেন। ফকির, বাউলদের জীবনযাত্রা থেকে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলায় যুক্তসাধনার নানা দিক নিয়ে তিনি লেখেন। আজকের জীবনেও এই যুক্তসাধনার ভাবটির গভীর ব্যাপ্তি অমর্ত্য বার বারই স্মরণ করিয়েছেন। তাঁর লেখা ভূমিকায়, ভারতের ইতিহাসের নানা দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৬০০ সালে রোমে অ-খ্রিষ্টানদের পুড়িয়ে মারার সময়ে আগরায় সব ধর্মের মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে আকবরের বক্তৃতার কথা লেখেন নোবেলজয়ী চিন্তাবিদ। বিভাজনের নানা চেষ্টা রুখে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, রাজাগোপালাচারীদের সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত মত, পথ নিয়েও তিনি লেখেন। অমর্ত্য বারবারই রোজকার জীবনচর্যায় খেলার মাঠ থেকে যে কোনও কাজে এই যুক্তসাধনার সহজ, সরল ফলিত প্রয়োগে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।