• দুর্নীতি আর অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে তৃণমূলকে ‘দমদম দাওয়াই’ মোদীর, বাঙালি ‘অস্মিতা’তেও শান দিয়ে বললেন, ‘তৃণমূল যাবেই’
    আনন্দবাজার | ২২ আগস্ট ২০২৫
  • দমদমের জেল মাঠে রাজনৈতিক সভার মঞ্চে পৌঁছোনোর আগে তিনি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিচ্ছিলেন ওই মাঠেরই এক কোণায় তৈরি প্রশাসনিক সভার ঘেরাটোপের ভিতরে। ভাষণ শেষ করার সময়ে বললেন, ‘’আর বেশি বলব না। পাশেই রাজনৈতিক সভায় অনেকে অপেক্ষা করছেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির বিষয়ে অনেক আলোচনা হবে। আরও অনেক কিছু হবে।’’ শেষ বাক‍্যটির উচ্চারণের সঙ্গে লেগে ছিল কটাক্ষের হাসির রেখা। ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, রাজনৈতিক সভায় তৃণমূলের জন‍্য ‘অনেক কিছু’ বেরোবে তাঁর ঝুলি থেকে। হলও তাই। ৪০ মিনিটের ভাষণে যতগুলি প্রসঙ্গ টানলেন, সেগুলির প্রায় প্রত্যেকটিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করার চেষ্টা করলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার সবচেয়ে বেশি শান দিলেন তিন অস্ত্রে— দুর্নীতি, অনুপ্রবেশ আর বাঙালি অস্মিতা।

    তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘বেলাগাম দুর্নীতির’ অভিযোগ তুলে মোদী যে শুক্রবার সরব হবেন, সে আভাস বঙ্গের বিজেপি নেতৃত্ব বৃহস্পতিবারই দিয়েছিলেন। তবে ভাষণের এক-তৃতীয়াংশই খরচ করে দেবেন দুর্নীতি প্রসঙ্গে, তা আগে বোঝা যায়নি। দমদমে মোদীর ভাষণে বার বার উঠেছে দুর্নীতির কথা। কখনও বলছেন, “দুর্নীতি আর অপরাধ তৃণমূলের সরকারের পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ কখনও কেন্দ্রের পাঠানো অর্থ ‘তৃণমূলের ক‍্যাডারদের’ পকেটে চলে যায় বলে অভিযোগ করেছেন। কখনও সংসদে সদ‍্য পেশ হওয়া ‘দুর্নীতি বিরোধী’ বিলের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন।

    গত ১১ বছরে রেল, জাতীয় সড়ক সহ কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর সরকার পশ্চিমবঙ্গের জন‍্য আগের সরকারের চেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ করেছে, মোদী প্রথমে তার হিসাব দেন। তার পরে মোদী বলেন, “কিন্তু এখানে একটি বড় সমস্যাও রয়েছে। সেটি হল আমরা পশ্চিমবঙ্গের বিকাশের জন্য যে টাকা পাঠাই, তার সিংহ ভাগ এখানে তৃণমূল লুটে নেয়। আপনাদের জন্য সেই টাকা খরচ করা হয় না, সেই টাকা তৃণমূল ক্যাডারদের জন্য খরচ করা হচ্ছে। এই জন্য গরিব কল্যাণে এই রাজ্য অনেক পিছনে পড়ে।’’ তিনি বলেন, ‘‘কিছু বছর আগেও অসম, ত্রিপুরায় এই অবস্থা ছিল। যখন থেকে সেখানে বিজেপি সরকার এসেছে, গরিব কল্যাণের লাভ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ঘরে জল, আয়ুষ্মান ভারত, গরিবদের জন্য পাকা বাড়ি— সমগ্র দেশের মানুষ পাচ্ছেন। এই সব লাভ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য পেতে হলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার চাই।’’

    দুর্নীতি বিরোধী আইনের আওতায় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং অন‍্য মন্ত্রীদের আনতে সদ‍্য সংসদে একটি বিল পেশ করেছে মোদীর সরকার। গোটা বিরোধী শিবির সে বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এমনকি, অমিত শাহ যখন বিল পেশ করেছিলেন, তখন বিলটির প্রতিলিপি ছিঁড়ে তাঁর দিকে ছুড়েও দেওয়া হয়। মোদীর ভাষণে শুক্রবার সে প্রসঙ্গও এসেছে। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে যদি কোনও ছোট সরকারি কর্মীও গ্রেফতার হন, তা হলে ৫০ ঘণ্টার মধ্যে জামিন না-পেলে তাঁর চাকরি চলে যায়। একজন ছোট কর্মীও যদি দু’দিন জেলে যান তা হলে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী যদি জেলে যায়, তার জন্য কোনও আইন নেই।” এই কথাগুলি অবশ‍্য পশ্চিমবঙ্গে আসার আগে শুক্রবার বিহারের সভাতেও বলেছিলেন মোদী। দমদমে দ্বিতীয় বার একই কথা বলেন। আজকাল জেলে বসেও সরকার চালানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার পরেই নাম না-করে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলকে আক্রমণ করেন। মোদী বলেন, ‘‘তৃণমূলের এক মন্ত্রী শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও জেলে রয়েছেন। তাঁর ঘর থেকে নোটের পাহাড় পাওয়া গিয়েছে, তার পরেও পদ ছাড়তে চাননি। রেশন কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের আর এক মন্ত্রীও জেলে যাওয়ার পর মন্ত্রিত্ব ছাড়তে চাননি।’’ মোদীর কথায়, “এঁরা সংবিধানের পরোয়া করেন না। যাঁরা জনগণকে এ ভাবে ধোঁকা দেন, তাঁদের কোনও অধিকার আছে পদে থাকার? এটা সংবিধানের অপমান। এই অপমান আমরা হতে দেব না।’’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ঠিক করেছি, এঁদের সবাইকে আইনের আওতায় আনব। যদি প্রধানমন্ত্রীও জেলে থাকেন, তা হলে তাঁর পদও চলে যাবে। কিন্তু তৃণমূলের লোকজন এর বিরোধিতা করছেন। তৃণমূলের লোক সংসদে এই বিল ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছেন। এর অর্থ হল তৃণমূলের রাজনীতি দুর্নীতির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।”

    অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে মোদী যেমন তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়েছেন, তেমনই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে আশ্বস্ত করার মতো বার্তাও দিয়ে গিয়েছেন। শুভেন্দু নিজের ভাষণে মোদীর উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনি জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ আর ৩৫-এ ধারা প্রত্যাহার করেছেন। আপনি ওয়াকফ আইন পাশ করেছেন। আপনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে রামমন্দির দিয়েছেন। শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাঙালি হিন্দু হোমল‍্যান্ড আপনাকেই বাঁচাতে হবে। আপনিই পারবেন। আমরা বাঙালিরা বাঁচতে চাই।’’ মোদী নিজের ভাষণে এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সরাসরি শুভেন্দুর নাম করেননি। কিন্তু বলেন, “এই বছর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। বিজেপির জন্মও তাঁর হাতে। আমরা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সৈনিক। আমরা মা ভারতীর সেবক। তাঁর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছি।’’

    এর পরে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে বলেন, “এ বার লালকেল্লা থেকে একটি বড় বিষয় নিয়ে আমি কথা বলেছি। অনুপ্রবেশ যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সময়ের থেকে এগিয়ে ভাবেন। আপনারা দেখবেন, উন্নত দেশগুলি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছে। আমরাও অনুপ্রবেশের সমস্যা আর সহ্য করব না।’’ মোদী প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে বলেন, “অনুপ্রবেশকারীদের কে তাড়াবে? বাংলাকে অনুপ্রবেশকারীদের থেকে কে মুক্ত করতে পারে? আপনার একটি ভোট এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক বার ভোট দিন, এরা সবাই পালাবে। যে সব অনুপ্রবেশকারী আমাদের যুবকদের রোজগার ছিনিয়ে নিচ্ছে, পরিকাঠামোর উপর চাপ সৃষ্টি করছে, মা-বোনেদের উপর অত্যাচার করছে, আমরা তাদের থাকতে দেব না। তাই এত বড় অভিযান চালাচ্ছি আমরা।’’

    এর পরেই তৃণমূলকে আক্রমণ করে বলেন, “তৃণমূল এবং কিছু রাজনৈতিক দল ক্ষমতা এবং ভোটের জন্য এদের সমর্থন করছে। কিছু জায়গায় এদের সাহায্যও নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী রাজ্য। যে ভাবে অনুপ্রবেশ বাড়ছে, তাতে এটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। কৃষকদের জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। আদিবাসীদের জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এটা সহ্য করা যাবে না। তাই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ মিশনের ঘোষণা করা হয়েছে।’’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘যারা নকল কাগজ বানিয়ে এত দিন ধরে থাকছে, তাদের যেতেই হবে। এই কাজ যাতে সুষ্ঠু ভাবে করা যায়, তার জন্য তৃণমূল সরকারকেও যেতে হবে।’’

    গত ১৮ জুলাই দুর্গাপুরের সভাতেই মোদী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে ‘বাঙালি অস্মিতা’র প্রতি ‘শ্রদ্ধা’ প্রকাশ করা তাঁর অন‍্যতম ‘হাতিয়ার’ হতে চলেছে। দমদমেও যে সে প্রসঙ্গে বলবেন, তা প্রত্যাশিত ছিল অনেকের কাছেই। তাই কখনও তাঁর ভাষণে সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, গোষ্ঠ পাল, হরিনাথ দে-র নাম শোনা গিয়েছে। কখনও বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের কাছে ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বহু উপাদান রয়েছে, যা বিকশিত ভারতকে অনুপ্রেরণা দেবে। বিজেপি সরকার বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে সম্মান দিয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিতে পেরেছি।’’ মোদীর এই মন্তব্যের পরে সভাস্থলে বিজেপি কর্মীদের করতালিও প্রবল হয়েছে।

    মোদী ভাষণ শেষ করার আগে নতুন স্লোগান মুখস্থ করিয়েছেন কর্মীদের— “বাঁচতে চাই, বিজেপি তাই।’’ মোদী সভাস্থলে পৌঁছোনোর আগে রাজ্য বিজেপির অন‍্যতম সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ও এই স্লোগান একদফা শিখিয়েছিলেন সভাস্থলে উপস্থিত জনতাকে। জগন্নাথ জানিয়েছিলেন, এই স্লোগান রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের উদ্ভাবন। মোদী দমদমের সভার শেষ লগ্নে সেই উদ্ভাবনকেই স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছেন।

    রাতে দিল্লি ফিরে গিয়েও বাংলার কর্মসূচির ছবি সমাজমাধ‍্যমে পোস্ট করেছেন মোদী। যশোহর রোড স্টেশন থেকে বেরিয়ে দমদম জেল মাঠে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’ধারে যে জমায়েত মোদীকে দেখতে তথা স্বাগত জানাতে হাজির ছিল, সেই ভিড়ের ছবি পোস্ট করে মোদী লিখেছেন, ‘’এই ভালবাসার জন‍্য আমি কলকাতার মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন আশীর্বাদ দিতে। এই ভালবাসা আমাকে প্রতীকপ্রতিম শহরটার জন‍্য এবং গোটা পশ্চিমবঙ্গের জন‍্য আরও পরিশ্রম করতে অনুপ্রাণিত করে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)