• সবুজ-হলুদ-কমলা লাইনের মতো মেট্রোর কৃতিত্ব নিয়েও নানা রঙের দাবি! উদ্বোধনে মোদী, স্মৃতিকাতর মমতা, ছবি-সহ আসরে বামেরাও
    আনন্দবাজার | ২৩ আগস্ট ২০২৫
  • ইংরেজি প্রবাদে বলে, ‘সাফল্যের পিতা বহু’। যার মর্মার্থ, যে কোনও সাফল্যেরই দাবিদার অনেক। শুক্রবার কলকাতা মেট্রোর সম্প্রসারিত তিন রুটের উদ্বোধন ঘিরে আরও একবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হল।

    সাফল্যের ‘কেক’ মুখে তুলতে চায় সব রাজনৈতিক দলই। আবহমানকাল ধরে তেমনই হয়ে আসছে। শুক্রবার সম্প্রসারিত কলকাতা মেট্রোর সবুজ লাইনে (হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ) এসপ্ল্যানেডের সঙ্গে সংযুক্ত হল শিয়ালদহ। কমলা লাইনে দক্ষিণ কলকাতার রুবি থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস বরাবর মেট্রো চলবে পূর্ব কলকাতার বেলেঘাটা পর্যন্ত। আর হলুদ লাইনে নোয়াপাড়া থেকে মেট্রো যাবে বিমানবন্দর পর্যন্ত। মেট্রোর লাইনের নামকরণে যেমন রঙের ছড়াছড়ি, তেমনই তার কৃতিত্ব কার, তা নিয়েও নানা রঙের দাবি উঠতে শুরু করে দিয়েছে।

    প্রকল্পের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি কলকাতায় পৌঁছোনোর ঠিক আগে এক্স পোস্টে স্মৃতিকাতর হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর শিলান্যাসের ছবি নিয়ে কৃতিত্বের দাবি জানাতে মেট্রোর ট্র্যাকে নেমে পড়ল ভোটের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া বামেরাও।

    বছর ঘুরলেই বিধানসভা ভোট। তার আগে মোদীর হাতে উদ্বোধন হল মেট্রোর নতুন তিন রুটের, যাকে পুজোর আগে কলকাতা ও শহরতলির মানুষকে ‘উপহার’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। শুধু তা-ই নয়। মেট্রো প্রকল্পের উদ্বোধনী কর্মসূচিকে ‘পরিবর্তনের দিকে পথচলা’ বলেও উল্লেখ করেছেন সুকান্ত। সমাজমাধ্যমে বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরাও মোদীর সাফল্য হিসাবেই তুলে ধরতে চাইছেন মেট্রোর নতুন তিন রুটের উদ্বোধনকে।

    আবার মমতা তাঁর স্মৃতিবিজড়িত পোস্টে রেলমন্ত্রী হিসাবে প্রকল্পের সূচনা, তহবিল জোগাড় করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাকে বাস্তবায়িত করতে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। শুক্রবার সকালেই এ বিষয়ে গৌরচন্দ্রিকা করে রেখেছিলেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। বেলা গড়াতে মমতাও একটি পোস্ট করেছেন। পোস্টের শুরুতে তিনি লিখেছেন, ‘আজ একটু স্মৃতিকাতর হই!’ মমতা লিখেছেন, ‘রেলমন্ত্রী হিসেবে যে পরিকল্পনাগুলো করেছিলাম, সেগুলো ফিল্ডে যাতে সঠিক ভাবে শেষ হয় তার ব্যবস্থাও আমরাই করেছিলাম। এই সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মেট্রো পরিকাঠামো সম্প্রসারণ আমার একটি দীর্ঘ সফরের অন্যতম অংশ। আজ আমাকে কিছুটা নস্টালজিক হতে দিন।’

    প্রসঙ্গত, শুক্রবারের উদ্বোধন কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। কিন্তু মমতা সেখানে যাননি। বদলে তিনি উদ্বোধনের ঠিক আগে পোস্ট করে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, মেট্রোর এই সম্প্রসারণের কৃতিত্ব আসলে কার। মমতার সেই পোস্টের জবাব দিয়েছেন বিজেপির অমিত মালবীয়। তিনি লিখেছেন, ’১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন এক মুখ্যমন্ত্রীর মেট্রো উদ্বোধনের দিন এই নস্টালজিয়া হাস্যকর। উনি চাইলে এই প্রকল্প অনেক আগেই রূপায়িত হতে পারত। ওঁর প্রশাসন এই কাজে ক্রমাগত বাধা দিয়ে গিয়েছে। কলকাতাবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বদলে উনি এখন কৃতিত্ব নিতে ব্যস্ত।’

    পিছিয়ে নেই বামেরাও। ২০০৯ সালে ইউপি-১ সরকারের শেষ পর্বে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর শিলান্যাস হয়েছিল। সে বছর ২২ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে কলকাতায় হাজির ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীরা। সেই ছবি পোস্ট করে শুক্রবার বামেরা দাবি করছে, শুরুটা হয়েছিল তাদের আমলেই। এখন বাকিরা সাফল্যের অংশীদার হতে চাইছেন। বামেদের এ-ও অভিযোগ, সেই সময়ে প্রকল্পে বাধা দিয়েছিলেন মমতা। ঘটনাচক্রে, সেই শিলান্যাসের কয়েক মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় লোকসভা ভোট। তার পর দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে শরিক হয় তৃণমূল। মমতা পান রেল মন্ত্রক। অধুনা বাংলার শাসকদল তৃণমূলের বক্তব্য, এই প্রকল্পের কাঠামো গড়ে দিয়ে এসেছিলেন মমতা। তাতে রং করে কৃতিত্ব নিচ্ছে বিজেপি।

    সরকারি প্রকল্প সরকার থেকে সরকারে চলতে থাকে। রাজনৈতিক শাসক বদলে কোনও কোনও প্রকল্পের গতি দ্রুত বা মন্থর হয়। কোথাও বরাদ্দ বাড়ে। কোথাও আবার কমে। কিন্তু কৃতিত্ব নেওয়ার লড়াই নতুন নয়। যেমন বামেরা বলে থাকে, তাদের আমলের বিভিন্ন প্রকল্পে নীল-সাদা রং করে সেই প্রকল্প তৈরির কৃতিত্ব নিয়েছেন মমতা। আলিমুদ্দিনের নেতারা উদাহরণ দেন ‘মা’ উড়ালপুল এবং গীতা়ঞ্জলি স্টেডিয়ামের। আবার আরও পিছনে হাঁটলে দেখা যাবে কংগ্রেস জমানার নানা প্রকল্প চালু হয়েছিল জ্যোতি বসুর হাত ধরে। রাজনীতি যেহেতু বর্তমান নিয়ে বেশি নিবিষ্ট থাকে, তা-ই সংশ্লিষ্ট সমস্ত রাজনৈতিক দলই অতীতকে ভুলিয়ে দিয়ে কৃতিত্ব দখলের চেষ্টা করে। সংসদীয় রাজনীতির এটাই দস্তুর। শুক্রবার মেট্রোর নতুন তিন রুট উদ্বোধনে সেই পুরনো ধারাই দেখা গেল নতুন মোড়কে। মেট্রো লাইনের রঙের মতোই কৃতিত্বের দাবিতেও নানা রং। গেরুয়া, সবুজ এবং লাল।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)