কলকাতা মেট্রোর সম্প্রসারণের উদ্বোধনকে সামনে রেখে বিধানসভা ভোটে বাংলায় উন্নয়নের প্রশ্নেই বিজেপিতে আস্থা রাখার আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই নিশানা করলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। প্রসঙ্গত, আলিপুরদুয়ার, দুর্গাপুরের সভার পরে দলীয় আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গ-বিজেপিকে কেন্দ্রের উন্নয়নমুখী কর্মসূচির ইতিবাচক প্রচারকে হাতিয়ার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে দাবি। এই সূত্র ধরেই দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার মাঠে শুক্রবারের সভা থেকে বাংলার উন্নয়নের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং রাজ্যে ‘আসল পরিবর্তনে’র কথা বলে মোদী স্লোগান দিলেন, ‘বাঁচতে চাই, বিজেপি তাই।’ পাশাপাশি, বিজেপিকে বাংলা-বিরোধী বলে তৃণমূল-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন ধারাবাহিক আক্রমণ করছে, সেই আবহে বাংলার গুরুত্বের কথাও বিশেষ ভাবে উঠে এল মোদীর কথায়।
কলকাতার তিনটি মেট্রো-পথ এবং কোনা এক্সপ্রেসওয়ের সম্প্রসারণ প্রকল্পের উদ্বোধন করে মোদী এ দিন দলের ‘পরিবর্তন সঙ্কল্প সভা’ থেকে বাংলার উন্নয়নের প্রশ্নে তৃণমূলকে নিশানা করেছেন। তিনি বলেছেন, “বিকশিত বাংলা মোদীর গ্যারান্টি। আমাদের কাছে বাংলার উন্নয়নের রোড ম্যাপ আছে। কিন্তু তৃণমূল উন্নয়ন-বিরোধী।” কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পে রাজ্য সরকারের ‘বাধা’র অভিযোগ তুলে মোদীর সংযোজন, “তৃণমূল যে উন্নয়নের শত্রু, তার সাক্ষী দমদমের মানুষও। স্মার্ট সিটি প্রকল্পে এখানে অনেক উন্নতি হতে পারত। কিন্তু তৃণমূলের সরকার সেই প্রকল্পে যুক্ত হল না।” এর সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁর সংযোজন, “পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র যে টাকা পাঠায়, তার সিংহভাগ রাজ্য সরকার লুট করে। সেই টাকা তৃণমূল কর্মীদের জন্য খরচ করা হচ্ছে। তাই গরিব-কল্যাণে বাংলা অনেক পিছিয়ে।” তাঁদের দলকে ‘একটা সুযোগ’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে বিজেপি আমলের আগেকার ত্রিপুরা ও অসমের ‘উদাহরণ’-ও টেনে এনেছেন মোদী।
আগামী অর্থ-বর্ষের মধ্যে আরও ২২ কিলোমিটার মেট্রো-পথ পাবে কলকাতা মেট্রো, এ দিনই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় রেল ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিমন্ত্রী রবনীত সিংহ বিট্টু। কলকাতা মেট্রোর তিনটি নতুন সম্প্রসারিত পথের উদ্বোধন- মঞ্চে মোদীর নেতৃত্বের প্রশংসার পাশাপাশি ইঙ্গিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন রবনীত। তাঁর বক্তব্য, “কলকাতা মেট্রো আগে ২৮ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। এখন প্রধানমন্ত্রী ৩৯ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করেছেন। ২০১৪ থেকে অনেক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আগামী অর্থ-বর্ষের মধ্যে আরও ২২ কিলোমিটার সম্প্রসারণ হবে।” এর পাশাপাশি সংসদে তৃণমূল সাংসদেরা রাজ্যের জন্য যে কোনও দাবিদাওয়া নিয়ে সরব থাকেন না, সেই অভিযোগও তুলেছেন রবনীত।
পক্ষান্তরে, বিজেপি রাজ্যে এলে কী কী করতে পারে, তার নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদী। বন্ধ কারখানা খোলা, নতুন কারখানা তৈরি, বিপুল কর্মসংস্থান, রেল-মেট্রো প্রকল্পে আরও গতি, ‘ঐতিহ্য-পর্যটনে’র পরিকাঠামো তৈরির মতো নানা কথা বলেছেন তিনি। এই সূত্রেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, “বাংলায় আসল পরিবর্তন চাই। শুধু স্লোগান নয়, কাজে তার প্রতিফলন হবে। বাংলাতেই যুব সম্প্রদায় কাজ পাবেন, মহিলারা সুরক্ষিত থাকবেন, চাষিরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন, বাড়ি-ঘর পোড়ানো হবে না— এইগুলো আসল পরিবর্তন। এটা শুধু বিজেপি পারে। তাই বাংলার ঘরে ঘরে একটা কথা পৌঁছে দিতে হবে— বাঁচতে চাই, বিজেপি তাই।” রাজ্যে অতীতের কংগ্রেস, বাম আমলকে নিশানা করার সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ। দুর্নীতি আর অপরাধ তৃণমূল সরকারের পরিচয়।” পাশাপাশি, কেন্দ্রে ইউপিএ জমানার তুলনায় তাঁদের সরকার বাংলায় জাতীয় সড়ক ও রেলের জন্য তিন গুণ করে বেশি টাকা বরাদ্দ করেছে বলেও মোদী দাবি করেছেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘হেনস্থা’র অভিযোগকে সামনে রেখে বিজেপিকে যখন ‘বাংলা-বিরোধী’ বলে সরব হয়েছে তৃণমূল-সহ বিভিন্ন দল। এই প্রেক্ষিতেই দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাটের মতো বাংলার বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, গোষ্ঠ পাল, হরিনাথ দে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, নবজাগরণে বাংলার ভূমিকার কথা বিশেষ ভাবে স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরেই মেট্রো-প্রকল্পের উদ্বোধনের সূত্রে উন্নয়ন এবং দুর্গাপুজোকেও জুড়ে দিয়েছেন তিনি। মোদী বলেছেন, “এমন সময় কলকাতায় এসেছি, যখন দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কুমোরটুলিতে প্রতিমা গড়া হচ্ছে। কলকাতা আলোয় সেজে উঠছে। আস্থার সঙ্গে বিকাশ যখন জুড়ে যায়, তখন খুশি দ্বিগুণ হয়ে যায়।” তাঁর সংযোজন, “বাংলার ভাষা, সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে বিজেপি সরকার সব সময় চেষ্টা করছে। বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছি আমরা।”
মোদীর সভা ঘিরে এ দিন বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। সমাবেশ-স্থল উপচে পড়ার পাশাপাশি রাস্তার দু’ধারে, লাগোয়া গলি, বাজারেও প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। একই ভাবে মেট্রো রেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে মাঠে দলীয় সভায় যাওয়ার পথেও মোদীকে দেখতে রাস্তার দু’ধারে জড়ো হয়েছিলেন প্রচুর মানুষ।