• গতিহারা শহরের গতি কি বাড়াবে নয়া মেট্রোপথ
    আনন্দবাজার | ২৩ আগস্ট ২০২৫
  • ‘চণ্ডী’ পারেনি। ‘উর্বী’ও থেমেছিল বৌবাজারে। কিন্তু পারল ‘এমআর ৬১০’। বাধা কাটল প্রায় ছ’বছরের। সব মিলিয়ে জটিলতা কাটল এক দশকের।

    ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো পুবের শিয়ালদহ থেকে পশ্চিমমুখী যে পথে বৌবাজারের মাটির নীচ দিয়ে এসপ্লানেড যেতে বার বার ধাক্কা খাচ্ছিল, শুক্রবার সেই পথেই বাধা পেরোলো। যুক্ত হল পুবে জেগে ওঠা নতুন শহর নিউ টাউন-সল্টলেকের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন পশ্চিমের শহর হাওড়া। সেই সঙ্গেই কলকাতা পেল বিমানবন্দর পর্যন্ত মেট্রো যোগাযোগ। নোয়াপাড়া থেকে চারটি স্টেশন পার করে সহজেই পৌঁছনো যাবে জয় হিন্দ মেট্রো স্টেশন, অর্থাৎ বিমানবন্দরে। দক্ষিণ কলকাতা ও দক্ষিণ শহরতলির সঙ্গে যুক্ত হল বেলেঘাটা পর্যন্ত ৪.৩৯ কিলোমিটার নতুন মেট্রোপথও।

    কলকাতায় এসে যশোর রোড মেট্রো স্টেশন থেকে সমস্তটাই উদ্বোধন করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মেট্রো চড়ে সপার্ষদ যশোর রোড থেকে ঘুরে এলেন জয় হিন্দ মেট্রো স্টেশন পর্যন্তও। যার মধ্যে পড়ুয়াদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মাতলেন তিনি। ছবি তুললেন দেদার। মেট্রোযাত্রায় বললেন, ‘‘এই শহরের গতি বাড়ল। আগামী দিনে কলকাতা আরও গতিময় হবে।’’

    সাধারণ নাগরিক থেকে পরিবহণ ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্তদেরও দাবি, এই মেট্রোপথের সম্প্রসারণ আদতে কলকাতার পরিবহণ মানচিত্র অনেকখানিই বদলে দেবে। অনেকেই বলছেন, হাওড়া থেকে গণপরিবহণে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত যেতে সময় লাগে কম করে দু’ঘণ্টা। শহরের রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে বাসে চেপে যাওয়ার সেই স্মৃতি এ বার অনেকের কাছেই অতীত হতে চলেছে। তেমনই পেরোতে হবে না এসপ্লানেড থেকে শিয়ালদহ যেতে মৌলালি বা এস এন ব্যানার্জি রোডের যানজট। অফিস ছুটির পরে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, বৌবাজার হয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ারও কি আর প্রয়োজন পড়বে? বিমানবন্দর পর্যন্ত মেট্রোর সম্প্রসারণ হয়ে যাওয়ায় ভিআইপি রোডের যানজট থেকেও মুক্তিলাভ সম্ভব বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই বলছেন, বিশেষ করে পুজোর সময়ে ওই পথের জট নিয়ে কালঘাম ছুটবে না প্রশাসনেরও। নতুন মেট্রোপথের উদ্বোধনে হাজির উৎসুক এক যাত্রী আবার বলেই দিলেন, ‘‘কবি বলেছিলেন, কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে। এ বার হয়তো সে দিন কাটল। গতি এল কলকাতার।’’

    এ দিন নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে কলকাতায় পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দরে নেমে তিনি চলে যান যশোর রোডে। সেখানে তৈরি ছিল চিনা ডালিয়ান রেক। ৪টে ৪৬ মিনিটে সেখান থেকে তিনটি নতুন মেট্রোপথের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। নিজেও মেট্রোয় উঠে পড়েন। একই সময়ে মেট্রো চলা শুরু হয় কমলা লাইনের বেলেঘাটা থেকে রুবি মোড়, অর্থাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্টেশন পর্যন্ত ৪.৩৯ কিলোমিটার পথে। তবে, আলোচনার কেন্দ্রে ছিল শিয়ালদহ থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত মেট্রোর ২.৪৫ কিলোমিটার যাত্রা।

    ২০০৮ সালে শুরু হলেও এই প্রকল্প নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়। ২০১৪ সালে প্রকল্পের কাজ এক রকম থমকে যায়। তবে, সব চেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয় ২০১৯ সালে। বৌবাজারের নীচ দিয়ে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে ভিতরে জল ঢুকে বৌবাজারের একাধিক পাড়ায় একের পর এক বাড়িতে ফাটল ধরতে শুরু করে। রাতারাতি ঘরছাড়া হন অনেকে। থমকে যায় মেট্রোর কাজ। ওই সময়ে মেট্রোর সুড়ঙ্গেই বিসর্জন দিতে হয় টানেল বোরিং যন্ত্র ‘চণ্ডী’-কে। পরে টানেল বোরিং যন্ত্র ‘উর্বী’ শিয়ালদহ থেকে বৌবাজার পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ‘চণ্ডী’র অসমাপ্ত কাজ শেষ করে। তবে, যে পথে চণ্ডীর সলিলসমাধি ঘটেছিল, পশ্চিমমুখী সেই পথেই এ দিন শিয়ালদহ থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত গিয়েছে ‘এমআর ৬১০’। মেট্রো চালিয়েছেন গত বছরের মার্চে এসপ্লানেড থেকে গঙ্গার নীচ দিয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত মেট্রো চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটরম্যান জয়দীপ ঘোষ। উল্টোমুখী পথে শিয়ালদহে রেকটি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন আর এক মোটরম্যান চন্দন বিশ্বাস।

    ২০১৯ সাল থেকে বার বার আটকে যাওয়া পথেই বৌবাজারের নীচ দিয়ে এসপ্লানেড পর্যন্ত যাওয়ার ঘটনা কি কাকতালীয়, না কি পরিকল্পিত? প্রশ্ন শুনে স্মিত হাসি পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের জনসংযোগ আধিকারিক একলব্য চক্রবর্তীর ঠোঁটে। বললেন, ‘‘এই মেট্রোপথ হাওড়া ও শিয়ালদহের যোগাযোগের চিত্রই বদলে দেবে। আগামী দিনে প্রায় সাত লক্ষ যাত্রী এই পথে যাতায়াত করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)