এই সময়: এ যেন লম্বা সিরিজ়ের মাঝপথে ক্যাপ্টেন বদলাতেই বদলে গিয়েছে টিমের চেহারা। এ বার সংসদের বাদল অধিবেশনে তৃণমূলের পারফরম্যান্স দেখে নয়াদিল্লিতে প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এমনটাই মনে করছেন। সে সংসদের ভিতরে হোক বা বাইরে, টিমের সম্মিলিত পারফরম্যান্স, আন্দোলনের ঝাঁজ দেখেই তাঁদের এমনটা ধারণা।
এমনিতে এ বারের বাদল অধিবেশন অনেকগুলো দিক থেকেই ছিল ঘটনাবহুল। পহেলগামে জঙ্গিহানা, ‘অপারেশন সিঁদুর’ উত্তর পর্বে এটাই ছিল সংসদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। তা ছাড়া ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন (সার), দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে বাংলাভাষীদের নিগ্রহ, ১৩০তম সংশোধনী বিল পেশের মতো একগুচ্ছ বিষয়ে বারবার উত্তাল হয়েছে সংসদ। বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরের প্রতিবাদ–বিক্ষোভের জেরে সংসদের দুই কক্ষের অধিবেশনই অনেকবার মুলতুবি করতে হয়েছে। সেখানে বিরোধী শিবিরের সার্বিক প্রতিবাদের মধ্যে তৃণমূলকে আলাদা করে চোখে পড়েছে বলে মনে করছেন সংসদীয় রাজনীতিতে ওয়াকিবহাল মহল।
এর পিছনে লোকসভায় তৃণমূলের নতুন দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্যাপ্টেন্সি’র প্রশংসা করছেন অনেকেই। কোন কোন ক্ষেত্রে এ বারের বাদল অধিবেশনে তৃণমূলকে অনেক সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এর আগেও সংসদে অনেক বিষয়ে তৃণমূল সাংসদরা সরব হয়েছেন, বিভিন্ন বিতর্কে তাঁদের বক্তব্য নজর কেড়েছে সংসদে। তবে এ বার সেটা অনেকটা সংঘবদ্ধ ভাবে করেছে তৃণমূল। কয়েক মাস আগে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত বিরোধী সাংসদদের একটি প্রতিবাদ মিছিল চলাকালীন জোড়াফুলের দুই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহুয়া মৈত্রের মধ্যে আকচাআকচি একেবারে সামনে চলে এসেছিল।
তা ছাড়া কয়েকজন সাংসদ বিক্ষিপ্ত ভাবে দলের বাইরে কিছু মন্তব্য করায় তা নিয়ে তৃণমূলের অস্বস্তি বেড়েছিল। এ বার অধিবেশন শুরুর ক’দিন পরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভার্চুয়াল বৈঠক করে অসুস্থ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে অভিষেককে লোকসভায় জোড়াফুলের দলনেতার দায়িত্ব দেন। তারপর থেকে দলের পারফরম্যান্স অনেকটা বদলে গিয়েছে বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
তৃণমূল সূত্রের দাবি, দায়িত্ব নিয়েই অভিষেক আগে নজর দিয়েছেন লোকসভায় জোড়াফুল সাংসদদের মধ্যে সমন্বয়ের ফাঁকফোঁকর দূর করার কাজে। শুধু লোকসভা নয়, রাজ্যসভার সাংসদদের সঙ্গে সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি–দের সমন্বয় বাড়াতেও উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কে সংসদে বক্তব্য পেশ করলে দলের সার্বিক পারফরম্যান্স আরও ধারালো হবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূল আরও বেশি করে দাগ কাটতে পারবে— সেটা অনেক বেশি মসৃণ হয়েছে বলে মত জোড়াফুলের সংসদীয় টিমের অনেকের।
সংসদের অধিবেশন চলাকালীন দিল্লিতে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর বাসভবনে আয়োজিত ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক ও ডিনারে অভিষেকই ছিলেন কার্যত মধ্যমণি। সংসদে ‘সার’ ইস্যুতে যে একচুল জায়গাও ছাড়া হবে না, সেখানে সে বিষয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে সম্মত হন সবাই। তারপরে সংসদ থেকে কমিশনের অফিস পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়া’র শ’তিনেক সাংসদের মিছিলে মাটি কামড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়ে গোটা দেশের নজর কাড়েন তৃণমূল সাংসদরা। সংসদে প্রতিবাদ বিক্ষোভে একসঙ্গে সামিল হতে দেখা গিয়েছে কল্যাণ–মহুয়াকেও।
অভিষেক স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের শৃঙ্খলা মেনে জাতীয় ও রাজ্যের ইস্যুতে একজোট হয়েই এ ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তৃণমূলের এই লড়াকু মনোভাব দেখে বাংলা–বাঙালি ইস্যুতে জোড়াফুলের পাশে দাঁড়ায় কংগ্রেসও। এমনকী এই বিষয়ে সংসদে মুলতুবি প্রস্তাবও আনে তারা, যা জাতীয় রাজনৈতিক মহলে অনেকেরই নজর কেড়েছে। ‘সার’ নিয়ে প্রতিবাদে রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের সঙ্গে প্রথম সারিতে দেখা গিয়েছে অভিষেক ও সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো অখিলেশ যাদবকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের বক্তব্য, সংসদে এর আগে অনেক ইস্যুতে কংগ্রেস–তৃণমূল একসঙ্গে সরব হলেও দু’পক্ষের মধ্যে একটা সুপ্ত আন্ডারকারেন্ট থেকেই যাচ্ছিল। যাকে হাতিয়ার করে বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালিয়েছে বিজেপি। তবে এ বার ‘ইন্ডিয়া’র এই দুই প্রধান শক্তি একসঙ্গে লড়াই করে কেন্দ্রের শাসক শিবিরে চিন্তা বাড়িয়েছে। শুধু পথে নেমে আন্দোলন নয়, এই বিতর্কে কোন কোন পয়েন্টে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে চেপে ধরতে হবে, সে ক্ষেত্রেও অভিষেকের পরামর্শ প্রশংসিত হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের কাছে।
তিনি কেন্দ্রকে বিঁধতে ‘ই–স্কোয়্যার’ শব্দবন্ধ তুলে ধরেছিলেন— যেখানে একটি ‘ই’ হলো দেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও অন্যটি হলো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। বিরোধী শরিকদের স্লোগানেও এই শব্দবন্ধ জোরালো ভাবে উঠে এসেছে। কৌশলগত ভাবে সংসদের বাদল অধিবেশনের একেবারে শেষ লগ্নে কেন্দ্রের আনা সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ ঘিরে লোকসভায় বিরোধীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। সে দিন লোকসভায় তৃণমূলের নবনির্বাচিত ডেপুটি লিডার শতাব্দী রায়, মিতালি বাগ, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা যে ভাবে ওয়েলে নেমে সরব হন, তাতে কার্যত গুটিয়ে ছিল শাসক শিবির— এটাও নজরে এসেছে অনেকের।
তৃণমূল সূত্রের খবর, সে দিন প্রথমবার সংসদের অধিবেশন মুলতুবি হওয়ার পরে বিকেলে যখন ফের সভা বসে, তখন শাহকে ট্রেজ়ারি বেঞ্চে প্রথম সারি থেকে চতুর্থ সারিতে আসন গ্রহণ করতে দেখা যায়। এই বেনজির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল একেবারে তৃণমূল সাংসদদের প্রতিবাদের জেরেই— সংসদীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই সেটা মনে করছেন। সে দিন সংসদে প্রতিবাদ চলাকালীন কেন্দ্রের মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু ও রভনীত সিং বিট্টুরা যে ভাবে শতাব্দী, মিতালিদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন— সেটা জানামাত্র সঙ্গে সঙ্গে লোকসভার স্পিকারের কাছে অভিযোগ জানান তৃণমূলের দলনেতা অভিষেক।
তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, এই সিরিজ়ে তো মাঝপথে দায়িত্ব পেয়েছেন অভিষেক এবং সেখানেই জোড়াফুলের সাংসদদের বদলে যাওয়া বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখা গিয়েছে। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেও এর প্রভাব থাকবে এবং দিল্লিতে কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে তৃণমূল আরও সামনের সারিতে চলে আসবে বলেই প্রত্যাশা।