পেশাদারিত্ব, পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি! ডুরান্ড ফাইনালে হারলেও কলকাতার চতুর্থ প্রধান হওয়ার পথে এগোচ্ছে অভিষেকের ডায়মন্ড হারবার
আনন্দবাজার | ২৪ আগস্ট ২০২৫
প্রায় চার বছর আগে, এক বাংলা নববর্ষের দিন তিনি যখন নতুন স্বপ্ন নিয়ে ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন হয়তো তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবতেও পারেননি তাঁর দল ২০২৫-এর ডুরান্ড কাপের ফাইনালে উঠবে। নিজের সংসদীয় এলাকায় ফুটবলের প্রসার ঘটাতে এবং বাঙালি ফুটবলার তুলে আনতে যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, শনিবার তা নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেল। পেশাদারিত্ব, নিখুঁত পরিকল্পনা এবং ফুটবল নিয়ে দূরদৃষ্টির মন্ত্রেই এতদূর আসতে পেরেছে তারা। এ রকম সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম বার খেলতে নেমেই ফাইনালে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়।
মোহনবাগান, মহমেডান এবং ইস্টবেঙ্গল— কলকাতা ময়দানে গত একশো বছরের বেশি সময় ধরে দাপট দেখিয়েছে এই তিন ক্লাব। কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলের ‘তিন প্রধান’ হয়ে উঠেছে। তাদের আগে এবং পরে বহু ফুটবল ক্লাবই উঠে এসেছে। কালের গর্ভে তারা এক সময় হারিয়েও গিয়েছে। এখন কলকাতা ফুটবল চেনে এই তিন ক্লাবকেই। সেই একচ্ছত্র দাপটে এ বার ভাঙন ধরাতে শুরু করেছে ডায়মন্ড হারবার। কলকাতার ‘চতুর্থ প্রধান’ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা। ডুরান্ড কাপ ক্যাবিনেটে হয়তো আসেনি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডানের মতো তিন প্রধান যখন ব্যর্থ, তখন তারা ফাইনালে খেলে ফেলেছে। এর পর আই লিগ জিতে আইএসএলে খেলার সুযোগ পেলে আনুষ্ঠানিক ভাবেই কলকাতার চতুর্থ প্রধান হওয়ার থেকে ডায়মন্ড হারবারকে কেউ আটকাতে পারবে না।
২০১৪-য় লোকসভা ভোটে জিতে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ হয়েছিলেন অভিষেক। তার ঠিক তিন বছর পর, ২০১৭ সালে তিনি শুরু করেন ‘এমপি কাপ’। লক্ষ্য ছিল, সংসদীয় এলাকার মানুষের মধ্যে ফুটবল নিয়ে আগ্রহ বাড়ানো এবং স্থানীয় ফুটবলারদের তুলে আনা। প্রথম থেকেই ‘এমপি কাপ’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই জনপ্রিয়তার মান দিন দিন বাড়তেই থাকে। প্রতি বছরই এই প্রতিযোগিতায় নতুন নতুন ফুটবলার উঠে আসতে দেখা যেত। তখনই অভিষেকের মাথায় এসেছিল একটা ফুটবল ক্লাব গড়ার কথা। ২০১৯-এর ‘এমপি কাপ’ ফাইনালের দিন অভিষেক বলেছিলেন, ডায়মন্ড হারবার থেকে একটা ফুটবল ক্লাব তৈরি করা হবে।
আচমকা করোনা চলে আসায় সেই ভাবনা ধাক্কা খায়। তবে ফুটবল ক্লাব তৈরির প্রচেষ্টা ভেতরে ভেতরে চলতেই থাকে। অবশেষে ২০২২-এর ১৫ এপ্রিল, নতুন বছরের প্রথম দিনে আনুষ্ঠানিক ভাবে ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাবের জন্ম হয়। তৈরি হয় স্লোগান, ‘দমদার ডায়মন্ড হারবার’। আইএফএ-র সহযোগিতায় শুরুতেই প্রথম ডিভিশনে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা।
প্রথম থেকেই এই ক্লাবের কাজকর্ম ছিল পেশাদারিত্বে মোড়া। সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পেজ এবং ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে ফুটবলার নেওয়া, পরিকাঠামো— সবই ছিল নিখুঁত ভাবে নিয়ন্ত্রিত। প্রথমে এই দলের কোচিং করাচ্ছিলেন দেশের প্রাক্তন ফুটবলার কৃষ্ণেন্দু রায়। পরে কোচ হিসাবে আনা হয় মোহনবাগানকে আই লিগ জেতানো কিবু ভিকুনাকে।
প্রাথমিক ভাবে বাটানগরের মাঠে ডায়মন্ড হারবারের অনুশীলন হত। এখন তারা সরে এসেছে বিধাননগর স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মাঠে। ডায়মন্ড হারবারের উদ্যোগেই সেই মাঠের খোলনলচে বদলে গিয়েছে। শুরুর দিকে বাটানগরেই বেশ কয়েক বার ট্রায়াল ডেকে দলে ফুটবলার নেওয়া হয়। পাশাপাশি ভারতীয় ফুটবলের বিভিন্ন ক্লাব থেকে ফুটবলার নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে দেওয়া হয়। অবশেষে ২০২২-এর ২৬ জুলাই, কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে পোর্ট ট্রাস্টের বিরুদ্ধে খেলতে নামে ডায়মন্ড হারবার, যা তাদের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ।
ক্লাবের শুরুর দিককার কথা বলতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের আগে স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছিলেন কিবু। বলেছিলেন, “তিন বছর আগে আমরা বাটানগরে খেলতে নেমেছিলাম পোর্ট ট্রাস্টের বিরুদ্ধে। তিন বছর পর ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে নামছি। ইস্টবেঙ্গলের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলছি। দারুণ একটা সময় কাটিয়ে এলাম, তাই না? শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। মনে আছে, দলে ফুটবলার ছিল না বলে ট্রায়াল হয়েছিল। খুব কঠিন ছিল সেই সময়টা। অবশেষে তার একটা পুরস্কার পেয়েছি।”
কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশন থেকে পরের বছরই প্রিমিয়ারে ওঠে ডায়মন্ড হারবার। গত মরসুমে প্রিমিয়ারেও চমকে দিয়ে উপরের দিকে শেষ করে। আইএফএ ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দেওয়ায় হাইকোর্টে মামলা করে ডায়মন্ড হারবার। সেই মামলার রায় এখনও হয়নি। হাইকোর্ট ডায়মন্ড হারবারের পক্ষে রায় দিলে তারা প্রিমিয়ারেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করবে।
সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতাতেও সাফল্য অধরা থাকেনি। আই লিগ ৩ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আই লিগ ২-এ খেলার যোগ্যতা অর্জন। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে এ বছর আই লিগের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে তারা। আই লিগ ২-এ একটা ম্যাচেও হারেনি। এ বার লক্ষ্য আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আইএসএলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা। তার জন্য পঞ্জাব এফসি থেকে লুকা মায়চেন, ক্লেটন সিলভেইরা, মিকোল কোর্তাজ়ারকে সই করিয়েছে তারা। রয়েছে ঘরোয়া ফুটবল চষে ফেলা জবি জাস্টিন, হোলিচরণ নার্জারির মতো ফুটবলারও।
কলকাতার তিন প্রধানের প্রচুর সমর্থক রয়েছেন। চতুর্থ প্রধান হতে গেলে ডায়মন্ড হারবারকেও সমর্থকদের ভিত তৈরি করতে হবে। ধীরে ধীরে হলেও ক্রমেই সেই দিকে এগিয়ে চলেছে ডায়মন্ড হারবার। বিশেষ একটা এলাকার প্রতিনিধিত্ব করার ফলে সেখানকার সমর্থন তো রয়েছেই। পাশাপাশি অন্যান্যরা ফুটবলপ্রেমীরাও সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাবের সব কাজ যিনি দেখেন, সেই আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন, “ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান একশো বছরের পুরনো ঐতিহ্যশালী দুই ক্লাব। রাতারাতি তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তবে আমরাও সমর্থকদের একটা ভিত তৈরি করার চেষ্টা করছি। ডায়মন্ড হারবারের তিনশো ক্লাবের সঙ্গে কাজ করছি। স্থানীয় সমর্থকেরা পাশে রয়েছেন। বড় ট্রফি জিতলে আশা করি বাংলার বাকি মানুষও আমাদের পাশে থাকবেন।”
ভাল দল তৈরি করতে গেলে লাগে অর্থ। সাংসদ অভিষেক নিজের সাধ্যমতো সে ব্যাপারে চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি প্রচুর স্পনসরও এগিয়ে আসছে ডায়মন্ড হারবারের সঙ্গে যুক্ত হতে। কলকাতার এক প্রধান মহমেডান যখন তীব্র আর্থিক সমস্যায় ভুগছে, তখন ডায়মন্ড হারবারে উল্টো চিত্র। তাদের সঙ্গে এখন অনেক স্পনসর যুক্ত।
এত কিছুর পরেও একটা প্রশ্ন বিভিন্ন মহল থেকে ওঠে। তা হল, প্রথম সারির এক রাজনীতিবিদের এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকা। এখনও বিভিন্ন মহলে ডায়মন্ড হারবার পরিচিত ‘অভিষেকের ক্লাব’ বলে। ক্লাবের অন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, দলের ভালমন্দের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখলেও অভিষেক কোনও দিন অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না। কোন ফুটবলার নেওয়া হবে, কাকে ছাড়া হবে, কাকে কোচ করা হবে— এ রকম ফুটবলীয় বিষয় তিনি পেশাদারদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ক্লাবের বিপদের সময়েও তিনি যথাসম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করেন। ডুরান্ডে মোহনবাগানের কাছে হারের পর তিনি ক্লাবের সকলের জন্য নৈশভোজ আয়োজন করেছিলেন। নিজে উপস্থিত না থাকলেও এক বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন, এই হারে ভেঙে পড়লে চলবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ক্লাবের এক কর্তা বলেছেন, “ফুটবলের প্রতি সাংসদের ভালবাসা দেখে আমরাই অবাক হয়ে যাই। এত কাজের মধ্যে ঠিক ডায়মন্ড হারবারের খোঁজখবর রাখেন। সব ঠিকঠাক চলছে কি না, কোনও কিছুর দরকার কি না নিয়মিত জিজ্ঞাসা করেন। দল জিতলে আমাদের চেয়েও বেশি খুশি হন। সমাজমাধ্যমে ওঁর পোস্ট নিশ্চয়ই সকলে দেখতে পান। আমরা ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ।” এখন দেখার, শনিবারের হারের পর অভিষেক কী ভাবে দলকে চাঙ্গা করেন।
ডুরান্ড কাপ হয়তো এ বারও কলকাতায় এল না। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা মনে রেখে দিল ডায়মন্ড হারবারকে, যারা আইএসএলের দুই প্রতিপক্ষ জামশেদপুর, ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে। আগামীর সাফল্যের ভিত হয়তো শনিবারের যুবভারতীতেই তৈরি হয়ে গেল।