জলপাইগুড়ির বনমালী সরকারের শিল্পের কদর বিদেশেও, তিস্তায় ভেসে আসা কাঠ দিয়ে তৈরি করেন ভাস্কর্য, বাড়িতেই চলে শিল্পকর্মের পাঠশালা
বর্তমান | ২৫ আগস্ট ২০২৫
ব্রতীন দাস, জলপাইগুড়ি: তিস্তা পাড়ে বাস, ভাবনা বারোমাস! সাত দশকের জীবনে তিস্তার অনেক ভাঙা-গড়া দেখেছেন। আর এটা দেখতে দেখতে ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির রহস্য খুঁজে পেয়েছেন জলপাইগুড়ির বনমালী সরকার। ভূমিধস, বন্যায় তিস্তায় ভেসে আসা গাছের ডালপালা, কাঠ সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর সেই পরিত্যক্ত কাঠের উপর ফুটিয়ে তোলেন নিজের শিল্পকর্ম। নদীতে ভাসতে থাকা কিংবা নদীর পাড়ে অনাদরে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় অনবদ্য রূপ পায়। কোনওটিতে ফুটে ওঠে পশুপাখির অবয়ব, কোনওটি দেখতে লাগে হুবহু দেবদেবী কিংবা মনীষী। বনমালীর ভাস্কর্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও সমাদৃত।
কুমোরটুলিতে যেমন থরেথরে সাজানো থাকে প্রতিমা, তেমনই সেনপাড়ায় বনমালীর কারখানায় রয়েছে তিস্তায় ভেসে আসা হাজার হাজার পরিত্যক্ত কাঠ, গাছের ডালপালা, শিকড়। সেসবকে কেটে-ছেঁটে সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকেন সত্তরে পা দেওয়া এই শিল্পী। শুধু নিজে নয়, দুই ছেলের পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মকে কাটুম কুটুম শিল্পকর্ম শেখাতে তিস্তাপাড়ে নিজের বাড়িতেই খুলেছেন ‘পাঠশালা’। সেখানে ফেলে দেওয়া কাঠ দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি শিখছেন অনেকেই। বনমালীর শিল্পকর্ম দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, বিদেশ থেকেও মানুষ আসে। ঘরে ঠাসা শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তাঁরা।
প্রথাগত বিদ্যা বলতে কিছুই নেই বনমালীর। বাড়িতে নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শিখেছেন। সময় পেলেই গল্পের বই কিংবা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বসেন। প্রথম জীবনে বাবা-কাকার সঙ্গে চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু নিজেদের খুব একটা বেশি জমি না থাকায় চাষ করে পরিবারের সবার পেটের ভাত জোগাড় হতো না। ফলে চাষ ছেড়ে অন্য কাজের সন্ধানে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকেন বনমালী। একাজ সেকাজের পর একসময় ফার্নিচারের কারখানায় কাজ পান। তখন থেকেই কাঠের উপর শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলার নেশা চাপে।
বনমালীর কথায়, আমরা তিস্তার পাড়ে বাস করি। এই নদীকে ঘিরেই আমাদের সুখ-দুঃখ। তিস্তার পাড়ে বসে থাকতে থাকতে দেখেছি, অনেক কাঠ, গাছের ডালপালা, শিকড় ভেসে যায়। অনেকে জ্বালানির জন্য সেসব সংগ্রহ করেন। কিন্তু নদীতে ভেসে আসা এমন অনেক কাঠ কিংবা গাছের ডালপালা থাকে, যা দিয়ে অনবদ্য ভাস্কর্য তৈরি হতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই ২৫ বছর আগে আমার শিল্পকর্ম শুরু হয়।
বনমালীর কথায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে শিল্পকর্মের স্রষ্টা, সেই কাটুম কুটুমের জন্য কোনও হাতেখড়ি হয়নি আমার। কোন কাঠ থেকে কী তৈরি হতে পারে, সেই ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই সেগুলিকে শিল্পের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁর কথায়, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একাধিক সম্মান পেয়েছি। শান্তিনিকেতনেও সমাদৃত হয়েছে আমার হাতের কাজ। দেশের একাধিক রাজ্যে আমার শিল্পকর্ম যায়। আমেরিকা, ইতালি সহ একাধিক দেশেও আমার তৈরি কাটুম কুটুম গিয়েছে।