নিজের বিয়ে রুখে মেহেরুন্নেসা রোল মডেল, হতে চায় উকিল, রানিতলার নাবালিকার সাহসিকতাকে কুর্নিশ বাসিন্দাদের
বর্তমান | ২৫ আগস্ট ২০২৫
আনন্দ সাহা, লালবাগ: বয়স মাত্র পনেরো। অভাবি সংসার। দায় ঝেড়ে ফেলতে বাবা-মা তাকে পাত্রস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেইমতো দিনক্ষণও ঠিক হয়ে যায়। নির্দিষ্ট দিনে কনের সাজে পিঁড়িতে বসেও বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল রানিতলার প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরী মেহেরুন্নেশা খাতুন। পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকেরা। একাদশের ছাত্রী মেহেরুন্নেশা এখন বাল্যবিবাহ রোধে মুর্শিদাবাদ জেলার রোল মডেল। আগামীদিনে মেহেরুন্নেশা নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে আইনি পথে লড়তে চায়। তাই আইনকেই পেশা করতে চায় ওই কিশোরী।
বছর দেড়েক আগের কথা। তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার জোর প্রস্তুতি চলছে। মেহেরুন্নেশা খাতুন পনেরোর গণ্ডি পেরিয়ে সবে ষোলোয় পা দিয়েছে। মেয়েকে না জানিয়ে পাত্র ঠিক করে ফেলেন ভাগচাষি বাবা দোজাহান শেখ। গ্রামের লোকজন জানলে বিষয়টি প্রশাসনের কানে পৌঁছে যেতে পারে, তার জন্য রানিতলা থানার মেদেডুমুরিয়ার বাড়ি থেকে মেহেরুন্নেশা পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভগবানগোলা থানার ধনিরামপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই আশীর্বাদ এবং বিয়ের সব কিছু পাকা হয়ে যায় ওই নাবালিকার। সরাসরি বিরোধিতা করে লাভ হবে না। তাই মেহেরুন্নেশা বিয়ে ঠেকাতে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। অবশেষে মনে পড়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দিদিমণির কথা। বিয়ের দিন কোনওভাবে ওই কিশোরী ফোন করে নিজের বিয়ের বিষয়টি দিদিমণিকে জানায়। তড়িঘড়ি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ওই সদস্যা রানিতলা থানার দ্বারস্থ হন এবং পুলিস নিয়ে গিয়ে বিয়ের পিঁড়ি থেকে মেহেরুন্নেশাকে তুলে আনা হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ওই সদস্যা বলেন, বিয়ের আসরে ওই মেয়ে বাবা-মায়ের মুখের উপর বলে দেয় বিয়ে নয়, আমি হোমেই যাব। যদিও সাতদিন হোমে থাকার পর বাবা-মা মুচলেকা দিয়ে হোম থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন মেয়েকে। ইতিমধ্যে মেয়ের জেদের কাছে হার মেনেছেন তার বাবা-মা।
মেহেরুন্নেশা এখন নশীপুর হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের পড়ুয়া। জেলা প্রশাসন তো বটেই, স্কুলে, পঞ্চায়েতে বাল্যবিবাহ কর্মসূচি পালিত হলে সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজের গল্প শোনায় সে। বাল্য বিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনা করে। স্থানীয় ব্লক প্রশাসন, পুলিশ, একাধিক স্কুল তার সাহসিকতার জন্য সংবর্ধনা দিয়ে জন সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করছে। মেহেরুন্নেশা জানায়, বাল্যবিবাহ আইন বিরুদ্ধ। অনেক বাবা-মা আজও মেয়েদের বোঝা বা দায় মনে করেন৷ তাই ১৮ বয়সের আগেই পাত্রস্থ করে নিশ্চিন্ত হতে চান। সেই কারণেই কৈশোরেই হাতে উঠে যায় শাখা-পলা। মা হয়ে জরাজীর্ণ শরীর সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মেহেরুন্নেশার মা তাজমিরা বিবি বলেন, তখন মেয়ের কর্মকান্ড দেখে শরীরে মনে জ্বালা ধরেছিল। এখন বুঝছি, সত্যিই আমরা কত বড় ভুল কাজ করছিলাম। আমরাও এখন বাল্যবিবাহের কথা শুনলে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি। ভগবানগোলার এসডিপিও বিমান হালদার বলেন, মেয়েটি যে বাল্যবিবাহে রাজি নয় তা কোনও ভাবেই বুঝতে দেয়নি পরিবারের কাউকে। বরং সঠিক সময়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ফোন করে জানিয়ে দেয় তার অসম্মতির কথা। ও এখন জেলার মেয়েদের কাছে রোল মডেল। মেহেরুন্নেশা খাতুন।-নিজস্ব চিত্র