• টেবিলে তখনও ঢাকা দেওয়া দুপুরের খাবার
    আনন্দবাজার | ২৬ আগস্ট ২০২৫
  • সদ্য স্নান করা ভিজে চুল থেকে তখনও চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। সাদা মার্বেলের মেঝেতে রক্তের দাগ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে খুন করার পর মৃতদেহ টেনে সরানো হয়েছিল। স্নান করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাকটাও ঠিকমত পরে উঠতে পারেনি নিহত তরুণী। পরণে কালো টি-শার্টের নীচে গোলাপি রঙের টাওয়েল। মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন মা। খুনের খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিবেশীরাও ভিড় করতে শুরু করেছেন। হাজির পুলিশও। কৃষ্ণনগর শহরের একেবারে জনবহুল এলাকায় দিনেদুপুরে এমন ঘটনা কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।

    বাড়ির কাছেই কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ আর কৃষ্ণনগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। একটু দূরে জেলা জজের বাংলো। কিছু দূরে জেলাশাসক, পুলিশ সুপারের বাংলো। যে কারণে এই এলাকাকে নিরাপদ বলেই মনে করেন এলাকার মানুষ। জেলা প্রশাসনিক ভবন থেকে রাস্তাটি ১২ নম্বর জাতীয় সড়কে মিশেছে। সেই রাস্তার পাশেই নিহত ঈশিতা মল্লিকদের দোতলা পৈত্রিক বাড়ি। নীচের তলায় থাকেন বৃদ্ধ ঠাকুরদা প্রাক্তন সেনাকর্মী জয়দেব মল্লিক। পায়ের ব্যথার কারণে তেমন হাঁটতে চলতে পারেন না। উপরে ঈশিতা বাবা, মা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন।

    সোমবার বেলা দুটো নাগাদ মা কুমুম মল্লিক ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। বাবা দুলাল মল্লিক কৃষ্ণনগরেই একটি ব্যাঙ্কের কর্মী। সেই সময় তিনি ছিলেন কর্মক্ষেত্রে। ফলে বাড়িতে একাই ছিলেন ঈশিতা। সেই সুযোগই কাজে লাগিয়েছে অভিযুক্ত দেশরাজ সিংহ। পুলিশের অনুমান, খুব কাছ থেকেই ঈশিতার মাথায় গুলি করা হয়। মেঝের উপরে তখনও পড়ে আছে গুলির খোল।

    মা কুসুম মল্লিক ও বাবা দুলাল মল্লিকের দাবি, তাঁরা দেশরাজকে চেনেন না। কাঁচরাপাড়ায় থাকার সময় বা তারপরেও কোনও যুবক তাঁদের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত কি না বা কারও সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক ছিল কি না তা তাঁদের জানা নেই। মায়ের কথায়, ‘‘মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। নিট দেবে বলে গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেও কলেজে ভর্তি হয়নি। এতদিন ওর নিজস্ব কোনও মোবাইল ফোনও ছিল না। তিন-চারদিন আগে ওকে একটা ফোন কিনে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখান থেকে লুকিয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়।”

    পরিবার সূত্রেই জানা গিয়েছে, গত বছর নিটে পাশ করতে পারেন নি ঈশিতা। এবার তাই কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রবিবার কলকাতার একটি কলেজে ভর্তির ফর্ম ফিলাপও করেন। সোমবার বাবার সঙ্গে গিয়ে কলেজে ভর্তির কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়। বাবা দুলাল মল্লিক বলেন, “আমি ভাবলাম যদি কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তির সুযোগ পায় তাহলে আর কলকাতার কলেজে ভর্তি করব না।” ঘটনার পর যেন আফশোস তাঁর গলায়, “যদি মেয়েকে নিয়ে কলেজে ভর্তি করতে যেতাম তাহলে হয়তো এমন ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটত না।” দাদু জয়দেব শুয়েছিলেন নীচের তলার ঘরে। জাজান, একটা গুলির শব্দও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে তাঁদের বাড়িতেই, কল্পনাও করতে পারেননি। কিছু সময় পর উপর থেকে বউমার চিৎকার ও কান্নার শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, “ছেলেটা আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তাকে ধরার ক্ষমতা আমার নেই।”

    ঈশিতাদের বাড়ির পাশেই দোকান জয়ন্ত মোদকের। দোকান বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। জয়ন্তর কথায়, “ছেলেটা আমার দোকান বন্ধ করার অপেক্ষায় ছিল। যাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি ধরে ফেলতে না পারি।”

    খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানার পুলিশ এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে গাড়িতে তোলে। খাওয়ার টেবিলে তখনও ঢাকা দেওয়া আছে ঈশিতার জন্য দুপুরের খাবার। ভাত খেতে পছন্দ করতেন না। তাই রুটি আর তরকা রাখা ছিল। স্নান করে বেরিয়ে তা আর খাওয়া হল না।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)