• বিহারের ভোটার তালিকা থেকে মহিলাদের নাম বাদের ছড়াছড়ি, আসনভিত্তিক হিসাবেও বিস্ময়! উদাহরণে সতর্ক উদ্বিগ্ন তৃণমূল
    আনন্দবাজার | ২৭ আগস্ট ২০২৫
  • বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা (এসআইআর) নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগের মধ্যেই নাম বাদ পড়ার কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে এসেছে। যার মধ্যে অন্যতম, কয়েকটি জেলায় মোট যত নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, তার মধ্যে ৬৫-৭০ শতাংশই মহিলা। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট, বিহারের পর ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গেও এসআইআর হবে। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ায় বিহারে যে যে ছবি দেখা যাচ্ছে, তা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের জন্য কতটা উদ্বেগের?

    গত দেড় দশক ধরে একের পর এক নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকার অন্যতম ভিত্তি মহিলাদের সমর্থন। বিহারের ‘ছবি’ পশ্চিমবঙ্গে হলে তা শাসকদলের জন্য উদ্বেগের বলেই মত রাজনৈতিক মহলের অনেকের। তৃণমূল যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এসআইআর বা নাম বাদ পড়ার বিহারের এই ছবিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছে না। বরং তাদের বক্তব্য, বিহারের উদাহরণ দেখে সতর্ক হতে হবে। উদ্বিগ্ন না-হয়ে সতর্ক থাকাই এখন সাংগঠনিক কাজ বলে অভিমত তৃণমূল নেতাদের। যদিও একান্ত আলোচনায় তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা মানছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এক দিকে যেমন মহিলা ভোটারদের নাম বাদ পড়ছে, তেমনই পশ্চিবঙ্গে সংখ্যালঘু অংশের ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার জন্যও বিজেপি ‘চাপ’ তৈরি করবে। ঘটনাচক্রে, ভোটারদের এই দুই অংশই তৃণমূলের সমর্থনের অন্যতম ভিত্তি।

    পটনা, মধুবনী ও পূর্ব চম্পারণ— বিহারের এই তিনটি জেলায় সবচেয়ে বেশি ভোটারের নাম বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। মোট ১০.৬৩ লক্ষ। বাদ যাওয়া ভোটারদের মধ্যে যেমন পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা বেশি, তেমনই বয়সভিত্তিক হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে ১৮-৪০ বছর বয়সিদের নাম বাদ পড়ার হার বেশি। এই তিন জেলায় মোট ৩৬টি বিধানসভা আসন আছে। ২০২০ সালের ভোটে এর মধ্যে ২২টি আসন জিতেছিল বিজেপি-জেডিইউ জোট, ১৪টি আসন পায় কংগ্রেস-আরজেডি জোট। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই তিন জেলায় যত সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়েছে যে, তা অনেক আসনে প্রার্থীর জয়ের ব্যবধানের থেকেও বেশি। দেখা যাচ্ছে, যদি কোনও কেন্দ্রে গত ভোটে জয়ের ব্যবধান হয়ে থাকে ৩০ হাজার, সেখানে ৩৫ হাজার নাম বাদ চলে গিয়েছে। ফলে নতুন করে নাম না উঠলে আসন্ন ভোটে এই নাম বাদ পড়ার তালিকা ফলাফলের জন্য ‘নির্ণায়ক’ হতে পারে। এক কথায়, ভোটার তালিকার এই নিবিড় সমীক্ষা আসন্ন নির্বাচনের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে বিহারে।

    মঙ্গলবার কাঁকিনাড়ার একটি কর্মসূচি থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, নির্বাচন কমিশন একটি বিষয় ধরে ফেলেছে। তা হল, জন্মের হারের সঙ্গে ভোটার বৃদ্ধির হার মিলছে না। শুভেন্দুর দাবি, পরিসংখ্যান বলছে এক জন জন্মালে আড়াই জন ভোটার হচ্ছে রাজ্যে। অর্থাৎ ১০০ জন জন্মালে ২৫০ জন। এই বৃদ্ধি কেন? শুভেন্দুর বক্তব্য, তিনটি কারণে। প্রথমত, মৃতদের নাম রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এক জনের নাম রয়েছে দুই বা তিনটি জায়গায়। তৃতীয়ত, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা রাজ্যে ঢুকে ভোটার তালিকায় নাম তুলছে। যাদের সকলেই রোহিঙ্গা।

    তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘এত দিন বিজেপি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে বলত। এখন সেটাও হচ্ছে না দেখে ভোটার তালিকায় কারচুপি করতে চাইছে।’’ তৃণমূল কতটা উদ্বেগে? কুণালের জবাব, ‘‘উদ্বেগ নেই। তবে আত্মসন্তুষ্টি রাখলেও চলবে না। বুথে বুথে সতর্ক থাকতে হবে। সেই কাজই চলছে। একটা অবিরাম প্রক্রিয়া। বাংলায় একজনও যোগ্য ভোটারের নাম বাদ দিতে দেব না।’’

    প্রসঙ্গত, কখনওই কোনও নির্বাচনে ভোটার তালিকা ১০০ শতাংশ সঠিক থাকে না। প্রক্রিয়াগত কারণে ভোটার তালিকা নির্ভুল থাকার সম্ভাবনাও কম। ভোটার তালিকায় নাম তোলার কাজ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হয়। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ থেকে ভোট হওয়া পর্যন্ত সময়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাঁদের নাম থেকে যায় তালিকায়। তবে সে সংখ্যা নগণ্য। কমিশন চাইছে বছরের পর বছর ধরে যে মৃতদের নাম তালিকায় রয়ে যাচ্ছে, সেগুলি বাদ দিতে। ঘটনাচক্রে, এই ধরনের ভোটারদের ‘সুবিধা’ বরাবর শাসকদলই পায়। অতীতে বামেরাও পেত। গত দেড় দশক ধরে তৃণমূলও পাচ্ছে। এই সংখ্যা কি জেতা-হারা নির্ণয় করতে পারে? ভোট প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন যুক্ত একাধিক সরকারি কর্মীর বক্তব্য, একটি বুথের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা কম হলেও বিধানসভা বা লোকসভা ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে সংখ্যাটি নেহাত কম নয়। সর্বত্র না হলেও কোথাও কোথাও তা ‘নির্ণায়ক’ হয়।

    তৃণমূলের অনেকেই একান্ত আলোচনায় বলছেন, যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে এসআইআর করার প্রক্রিয়া চলছে, তা শুধুমাত্র মৃত বা একাধিক জায়গায় নাম থাকা ভোটারদের বাদ দেওয়া নয়। তৃণমূল মনে করছে, কেন্দ্র ধরে হিসাব কষে নির্দিষ্ট অংশের নাম বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। যা নিয়ে ‘উদ্বেগ’ গোপন করছেন না তাঁরা। উদাহরণ হিসাবে তাঁরা বলছেন মহারাষ্ট্রে ভোটের আগে অস্বাভাবিক হারে নাম বৃদ্ধি এবং দিল্লিতে কোনও কেন্দ্রে নাম কমে যাওয়া আবার কোনও কেন্দ্রে বেড়ে যাওয়ার অস্বাভাবিক হারের কথা।

    বিহারের ‘ছবি’ দেখে তৃণমূলে ‘উদ্বেগ’ রয়েছে। তবে বঙ্গের শাসকদল মনে করছে, বুথের সংগঠন দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ঠেকাতে পারবে। কারণ, বাড়ি ধরে ভোটার লিস্ট ‘স্ক্রুটিনি’র কাজে তারাই এগিয়ে। বিজেপি-সহ বিরোধীদের কারওরই সেই সংগঠন নেই।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)