দেবী প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বিভোর ‘বন্দেমাতরম’ রচয়িতা! কেমন ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির দুর্গাপুজো?
প্রতিদিন | ২৮ আগস্ট ২০২৫
যাদবচন্দ্রর একটি দানপত্র থেকে জানা যায়, চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর খরচ-খরচার দায়িত্ব ছিল সেজো ছেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর। কারণ ছেলেদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন আর্থিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল। মোটা মাইনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করার সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্রের পয়সা কড়ির কোন অভাব ছিল না। বরং বছর বছর তার বেতন বৃদ্ধি হয়ে তা এক বিপুল সংখ্যায় দাঁড়িয়েছিল সে যুগের নিরিখে। লিখছেন কিশোর ঘোষ।
‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’র রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্যসম্রাট’ উপাধির কথা সকলের জানা। ব্যক্তি জীবনে ‘সম্রাট’ না হলেও উনিশ শতকের বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার কাঁটালপাড়ার সুবিখ্যাত চট্টোপাধ্যায় পরিবার। এবাড়ির নাটমন্দিরে রীতিমতো জাঁক করে দুর্গাপুজো হত। যার গোড়াপত্তন করেন গোড়া সাহেবদের থেকে রায়বাহাদুর উপাধি আদায় করা বঙ্কিমের পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যিনি পেশায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। বঙ্কিমের বাড়িতে কবে থেকে প্রচলন হয় দুর্গোপুজো? পুজোয় কতখানি উৎসাহ ছিল স্বয়ং বন্দেমাতরমের সৃষ্টিকর্তার? সেকালে পুজোর খরচই বা কেমন কত? চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর সঙ্গে বন্দেমাতরম মন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে?
বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ২৬ জুন ১৮৩৮ (১৩ আষাঢ়, ১২৪৫ বঙ্গাব্দ) সালে। ঠিক দু’বছর পর ১৮৪০ সালে যাদবচন্দ্র তাঁর পৈতৃক এজমালি বাড়ির দক্ষিণ সীমায় দানপ্রাপ্ত এবং কিছুটা কেনা জমিতে প্রাসাদোপম দোতলা বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। সেই কাজ শেষ হয় ১৮৫২ সালে। এই বাড়িটির সামনের অংশে উত্তর সীমায় একটি ঠাকুরদালান নির্মাণ করে সেখানে দুর্গাপুজো এবং অন্য়ান্য আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন করেন। যাদবচন্দ্রর একটি দানপত্র থেকে জানা যায়, চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর খরচ-খরচার দায়িত্ব ছিল সেজো ছেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর। কারণ ছেলেদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন আর্থিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল। মোটা মাইনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্রের পয়সা কড়ির কোন অভাব ছিল না। বরং বছর বছর তার বেতন বৃদ্ধি হয়ে তা এক বিপুল সংখ্যায় দাঁড়িয়েছিল সে যুগের নিরিখে।
পুজোর যাবতীয় খরচখরচা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রচয়িতা যাদবচন্দ্রের সেজো ছেলে বহন করলেও, আয়োজনের সমস্ত তদারকি করতেন মেজো ছেলে সঞ্জীবচন্দ্র। কেমন ছিল সেই আয়োজন? আন্দাজ মেলে বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রের সংরক্ষিত নথি থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, ১২৯০ বঙ্গাব্দে (ইংরাজি ১৮৮৩ সাল) অনুষ্ঠিত পুজোয় মোট ব্যয় হয়েছিল ৪০৯ টাকা ৬ আনা আধ পয়সা। এর মধ্যে প্রতিমা গড়তে খরচ-৫১ টাকা ৬ আনা ৩ পয়সা, পুজোর খরচ-৬২ টাকা ১২ আনা, নৈবেদ্য খরচ-১১ টাকা ১০ আনা ১ পয়সা, খয়রাতিতে ব্যয়-৩৩ টাকা ১২ আনা ৫ গণ্ডা, রোশনাই-৪ টাকা ১৪ আনা ১ পয়সা, উপরি খরচ-৩৬ টাকা ১৪ আনা ৩ পয়সা, ভোগ ও খাই খরচ-১৭৬ টাকা ১৪ আনা সাড়ে ৩ পয়সা। পুজোর আগে ঘরবাড়ির মেরামতিতে খরচ-২০ টাকা ১৪ আন। এই হিসাবে মোট খরচের গরমিল ছিল ৬ আনা আড়াই পয়সা মতো। বিজয়া দশমীর দিন গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় নৌকা খরচ হয়েছিল ৩ টাকা।
প্রতিমা, পুজো, নৈবদ্যের জরুরি খরচ বাদ দিয়েও রোশনাই বা মণ্ডপ সাজানো ও অলোকসজ্জা, খয়রাতি বা দানধ্যান, ভোগ খাওয়ানোর মতো খরচ দেখলে বোঝা যায়, পুজোয় হাত খুলে ব্যয় করত চব্বিশ পরগনার কাঁটালপাড়ার সম্ভ্রান্ত চট্টোপাধ্যায় পরিবার। এই বিষয়ে
বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকারের লেখায় পাওয়া যায়—“আমাদের ওপারের রায়বাহাদুরদের বাড়ি ছিল যাত্রা-গান-মহোৎসবের মিলন মন্দির। …দুর্গোৎসবে কৃষ্ণনগর ঘূর্ণির উৎকৃষ্ট কুম্ভকার শশীপাল ঠাকুর গড়িবে, উৎকৃষ্ট চিত্রকর চুঁচুড়ার মহেশ ও বীরচাঁদ সূত্রধর চিত্র করিবে। প্রতিমা সর্বাঙ্গসুন্দর হইবে, জগমোহন স্বর্ণকারের চণ্ডীর গানে উচ্চকণ্ঠে মা মা রবের মোহিনীশক্তি। অথবা নীলকমলের প্রসিদ্ধ রামায়ণী গান। যাত্রা অঙ্গে বদন অধিকারীর তুক্কো বা গোবিন্দ অধিকারীর ‘কালীয়দমন’ গান। দাশরথী রায়ের কথায় ছটা-ঘটা সঙ্গে সঙ্গে তিনকড়ির সুরে-তালে মাখামাখি গান; সহচরী ও যাদুমণির কীর্তন; মধুকানের গান, এইরূপ ছোট-বড়ো-মাঝারি কতরূপ গান প্রায়ই হইত।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির দুর্গোপুজো নিয়ে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল—দুর্গাপুজোর সঙ্গে আনন্দমঠ তথ-সহ ‘বন্দোমাতরম’ রচনার যোগ। একাধিক গবেষক মনে করেন, স্বদেশসাধক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বাড়ির দুর্গোৎসব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কালজয়ী ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটি রচনা করেছিলেন। বিশিষ্ট বঙ্কিম গবেষক গোপালচন্দ্র রায়ের বক্তব্য-“১২৮১ সালের আশ্বিনে বা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্কিমচন্দ্র যখন মালদহের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন, তখনই পুজোর ছুটিতে মালদহ থেকে কাঁটালপাড়ার বাড়িতে এসে বাড়ির দুর্গাপূজা দেখে ‘আমার দুর্গোৎসব’ এবং পরে ‘বন্দেমাতরম’ রচনা করেন।” অতএব, ‘দুর্গেশনন্দিনী’র রচয়িতা আসলে ‘দুর্গেশনন্দন’, একথা বললে কিছু ভুল বলা হয় না।