পান্ডারাজ ভাঙতে অনলাইন ব্যবস্থা! গয়ার পথে হাঁটলে কী হবে কালীঘাট মন্দিরে? কী মনে করছেন পান্ডা ও সেবাইতেরা?
আনন্দবাজার | ২৮ আগস্ট ২০২৫
গয়ায় অনলাইনে পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করে পান্ডাদের চক্ষুশূল বিহার সরকার। প্রকল্প বন্ধের জন্য চাপ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী পর্যন্ত ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে পান্ডারাজ এক ঘোরতর সমস্যা। বহু চেষ্টাতেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। এঁটে উঠতে পারে না প্রশাসনও। পান্ডা সমস্যায় জর্জরিত হন কলকাতার একমাত্র সতীপীঠ কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে আসা পুণ্যার্থীরাও।
কালীঘাট মন্দিরের কাছাকাছি গেলেই মৌমাছির ঝাঁকের মতো পান্ডা থেকে দালালেরা এসে ছেঁকে ধরেন পুণ্যার্থীদের। তাঁদের জোর করে নিজ নিজ ডালার দোকানে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। সে কথা স্বীকার করেন মন্দির প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনও এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে না। এত কিছুর পরেও অনলাইনে পুজো দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ চুপ। তাঁরা দোহাই দিচ্ছেন আইনি জটিলতার। অনলাইন ব্যবস্থার বিরোধিতা শোনা যায় সেবাইতদের মুখেও। অন্য দিকে, স্বাভাবিক ভাবেই অস্তিত্বরক্ষায় অনলাইন ব্যবস্থা চান না কালীঘাট মন্দিরের পান্ডারা। তাঁদের দোহাই, পেটের ভাত বন্ধ হয়ে যাবে।
কালীঘাট মন্দিরে নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে পান্ডা ও দালালরাজ। মন্দির সূত্রে খবর, প্রায় ৫০০-৬০০ জন দালাল মন্দিরের সংলগ্ন রাস্তায় ঘোরাফেরা করেন। তাঁদের কাজ, পুণ্যার্থীদের ধরে ডালার দোকান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে দায়িত্ব যায় পান্ডাদের ঘাড়ে। শহরের একমাত্র সতীপীঠ ঘিরে প্রায় ১৫০টির বেশি ডালার দোকান রয়েছে। সেখানে গড়ে তিন জন করে পুরোহিত বা পান্ডা রয়েছেন। অর্থাৎ, ৪৫০ থেকে ৫০০ জন পান্ডা প্রতিদিন কালীঘাট মন্দিরচত্বরে কাজ করেন। দালালদের পাকড়াও করা পুণ্যার্থীদের নিয়ে কালীঘাট মন্দিরের ভিতরে পুজো দিতে নিয়ে যান তাঁরা।
অনলাইনে পুজো চালু হলে এই ব্যবস্থা ব্যাপক ভাবে ধাক্কা খাবে। তাই এ বিষয়ে কথা বলতেই চান না মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। গয়ার মতো কালীঘাটেও অনলাইন বিরোধিতায় ধর্মের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। একাধিক সেবাইতের কথায়, ‘‘কালীঘাটে মায়ের দর্শন করে পুজো দিলে যে পুণ্যলাভ হয়, অনলাইনে তা সম্ভব নয়।’’ মন্দিরের এক পান্ডা বলেন, “আমাদের মন্দিরে সরাসরি পুজো করার সুযোগ নেই। সেই ক্ষমতা রয়েছে কেবলমাত্র সেবাইতদের। তা ছাড়া আমদের নির্দিষ্ট বেতনও নেই। পুণ্যার্থীদের থেকে মেলা দক্ষিণাই আমাদের সম্বল।’’ তিনি আরও বলেন, “কেউ পুজো দিতে এলে কিছু আয় করার তাগিদে স্বাভাবিক কারণেই পান্ডাদের অতি উৎসাহী হয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তাই আমাদের কাজকর্মের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আর্থিক বিষয়টি নিয়েও ভাবা উচিত।’’ একই সুর দালালদের গলাতেও। তাঁদের কথায়, “কত জনকে ডালার দোকান পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারছি, তার উপর আমাদের রোজগার নির্ভর করে। কেউ দোকান পর্যন্ত গিয়ে পুজো না দিলে আমরা কমিশন পাই না।’’
পান্ডা এবং দালালদের মৌরসিপাট্টা কমাতে মন্দির কমিটি অনলাইন পুজো-পরিষেবা শুরু করার কথা আদৌ কি ভাবছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কালীঘাট টেম্পল কমিটির সভাপতি তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ শুভাশিস চক্রবর্তী বলেন, “কেউ ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করলে আমরা কালীঘাট মন্দিরে পুজো দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিতে পারি। কিন্তু এখনও মন্দিরে অনলাইন পুজো দেওয়ার মতো ব্যবস্থা করা হয়নি।’’ মন্দির কমিটির একটি সূত্র জানাচ্ছে, আদালতের নির্দেশে কালীঘাট মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব টেম্পল কমিটির। তবে তারা কোনও ভাবেই মন্দিরের পুজোপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পারবে না। আর পুজোর প্রক্রিয়া পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব আবার মন্দিরের সেবাইতদের। তাই অনলাইন পুজোর প্রক্রিয়া চালু করতে গেলে আইনগত জটিলতা রয়েছে।
এমতাবস্থায় কালীঘাট মন্দিরে পান্ডা বা দালালদের মৌরসিপাট্টা ভাঙার সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বর্তমানে কালীঘাট মন্দিরে পান্ডাদের দুটি পৃথক সংগঠন রয়েছে। একটি ‘সাথী ব্রাহ্মণ সংগঠন’ এবং অন্যটি ‘কালীঘাট কালীমন্দির ব্রাহ্মণ ও সহকর্মী সংগঠন’। দু’টি সংগঠনই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। এই সংগঠনগুলি থেকে জানা গিয়েছে, দু’টি পৃথক সংগঠন হলেও, বর্তমানে তাদের পরিচালনার চাবিকাঠি কালীঘাট এলাকার এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার হাতে। তাই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করে তাঁর বিরাগভাজন হতে নারাজ ওই পান্ডা এবং দালালেরা। সুতরাং, কালীঘাট মন্দিরের পান্ডাদের ‘ঠান্ডা’ করতে অনলাইন ব্যবস্থায় পুজো দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না মন্দির প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এক প্রবীণ কর্মকর্তা।