বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা, ঢাক বাজিয়ে ফের কলেজে যাচ্ছেন রিয়া, পেটের টানে মসলন্দপুর থেকে জলপাইগুড়িতে
বর্তমান | ২৮ আগস্ট ২০২৫
ব্রতীস দাস, জলপাইগুড়ি: ঢাকের বাদ্যি জানান দেয় পুজো আসছে। আর ঢাক বাজানোর বায়না মিললে হাসি ফোটে রিয়ার মুখে। কারণ, ঢাক বাজিয়েই বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশোনা ফের শুরু করতে পেরেছেন তিনি। কিনতে পেরেছেন বইখাতা। মিটিয়েছেন কলেজ-টিউশন ফি। রিয়ার মনের কোণে এখন একটাই স্বপ্ন, বাবার বয়স হচ্ছে। সংসারের জোয়াল টানতে টানতে ক্লান্ত মা। বোনটাও বড় হচ্ছে। বাড়ছে তাঁরও পড়াশোনার খরচ। ফলে ওদের তিনজনকে ভালো রাখা। আর তাই উত্তর ২৪ পরগনার মসলন্দপুর থেকে ছ’শো কিমি দূরে জলপাইগুড়িতে ঢাক কাঁধে এসেছেন হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজের ছাত্রী রিয়া বিশ্বাস।
বুধবার জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া একটি ক্লাবের খুঁটিপুজোয় ঢাকের তালে মাতাচ্ছিলেন রিয়া। তাঁর বাদ্যিতে পুজোর গন্ধ। কিন্তু রিয়ার মুখে যেন শরতের হাসি ফুটেও ফুটতে চায় না। বললেন, ঢাক বাজিয়ে যেটুকু অর্থ আসবে, বাড়ি ফিরে তা দিয়ে বাবা-মা আর বোনের পুজোর জামাকাপড় কিনে দিতে চাই। আমার কিছু না হলেও চলবে। কথা এগতেই চোখের কোণে জল গড়ায় কলাবিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রীর। শাড়ির আঁচলের খুট দিয়ে সেই জল মুছে রিয়া বলেন, আমি শুধু পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে চাই। চাকরি করে বাবা-মা আর বোনের পাশে যেন দাঁড়াতে পারি।
রিয়ার বাবা রণজিৎ বিশ্বাস। শিয়ালদহে ব্যাগ ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনে কাজ করেন। অশক্ত শরীরেও রোজ বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করতে হয় বাদুড়ঝোলা হয়ে। মা ফুলের মালা গেঁথে ভোরের ট্রেনে করে নিয়ে যান কলকাতায়। রিয়াদের বাড়ি ঠাকুরনগরে। সেখানেই বাবা-মা আর বোন থাকে। রিয়া থাকেন মসলন্দপুরে মাসির বাড়িতে। রিয়ার মাসি তুলসী সিংহ দশ বছর ধরে ঢাক বাজান। সংসারের হাল ধরতে তাঁর কাছেই ঢাক বাজানোর তালিম নিয়েছেন রিয়া।
এতদিন কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন পুজোয় ঢাক বাজানোর ডাক পেলেও এবারই প্রথম উত্তরবঙ্গে পা রাখা। বললেন, দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসার শখ। এত কাছে এসেও পাহাড় ছুঁতে পারলাম না। তবে জীবনে চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সব পাহাড় ডিঙোতে চাই। ১৯ বছরের রিয়ার মনে ভরপুর আত্মবিশ্বাস। বলেন, বান্ধবীরা মোবাইলে রিলস বানাতেই ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। আর আমি বায়না খুঁজি। কোথাও ঢাক বাজানোর ডাক পেলে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। বাবার মুখটাও যেন খুশিতে চিকচিক করে। ছোটখাট আবদার করে বোনটা। বুঝি, ওরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
রিয়ার সঙ্গে জলপাইগুড়িতে এসেছেন তাঁর মাসি তুলসী সিংহও। বললেন, মেয়েটার কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পড়া ছাড়তে নারাজ রিয়া। ঢাক বাজিয়েই ও নিজের পড়াশোনা চালানোর পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেছে।