ব্যবধান এক বছরের, দু’টি ছবি দেখল ২৮ অগস্টের মঞ্চ, আরজি কর নিয়ে সে বার ‘রক্ষণাত্মক’ অভিষেক এ বার ‘আক্রমণাত্মক’
আনন্দবাজার | ২৮ আগস্ট ২০২৫
ফারাক ঠিক এক বছরের। ২৮ অগস্ট ২০২৪ থেকে ২৮ অগস্ট ২০২৫। জায়গা এক, মঞ্চও এক। ৩৬৫ দিনের ফারাকে সেই মঞ্চে দুই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গেল। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে রাজ্য জুড়ে উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই গত বছর ২৮ অগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচি হয়েছিল। এক বছর আগে সেই মঞ্চ থেকে আরজি কর নিয়ে অভিষেক ছিলেন ‘রক্ষণাত্মক’। এক বছর পরে সেই আরজি কর প্রসঙ্গ টেনে ‘আক্রমণাত্মক’ বক্তৃতা করলেন অভিষেক।
আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল গত বছর ৯ অগস্ট সকালে। তার পর ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচিকে ঘিরে অভূতপূর্ব ছবি দেখেছিল বাংলা। সেই পর্বে কুণাল ঘোষের মতো তৃণমূল নেতারা রাত দখলকে ‘রাম-বামের কর্মসূচি’ বলে কটাক্ষ করলেও অভিষেক ২৮ অগস্টের মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, ‘‘আমি মহিলাদের রাত দখলকে সম্মান জানাই। তাঁদের দাবি ছিল দু’টি। এক, ধর্ষণমুক্ত সমাজ এবং দুই, দোষীদের শাস্তি।’’ সেই প্রথম কোনও তৃণমূলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা রাত দখলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অনেকের বক্তব্য ছিল, মানুষের মন বুঝেই সে কথা বলেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
এক বছর কেটে গিয়েছে। আরজি কর আন্দোলন স্তিমিত। কার্যত উধাও। ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় একমাত্র দোষী সঞ্জয় রায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছেন। যে সঞ্জয়কে ঘটনার এক দিনের মধ্যে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। সেই আবহে এক বছর পরে আরজি কর নিয়ে পাল্টা রাজনৈতিক আক্রমণের রাস্তায় হাঁটলেন অভিষেক। তিনি বললেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতা পুলিশ যা এক দিনে করেছিল, নরেন্দ্র মোদীর অধীনে থাকা সিবিআই এক বছরেও করতে পারেনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি এই দিনেই গত বছর রাত দখলকে সমর্থন করেছিলাম। তার পর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘অপরাজিতা বিল’ রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের নারকীয় ঘটনা রোখা যায়। কিন্তু আজ এক বছর কেটে যাওয়ার পরেও সেই বিল আইনে পরিণত হয়নি। এক বছর আগে যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগের উদ্দেশ্য ছিল গরিব মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেছেন, তা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া। আজ তাঁরা কোথায়? অপরাজিতা বিল নিয়ে তাঁরা রাস্তায় নামছেন না কেন?’’ স্পষ্টতই অভিষেকের নিশানায় ছিলেন বাম, কংগ্রেস, বিজেপি নেতৃত্ব।
আরজি কর পর্বে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যেও ‘দূরত্ব’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ছিল শাসকদলের অন্দরে। সেই সময়েই দলের তরফে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় রাখার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতর। যদিও কয়েক মাস হল সেই দায়িত্ব আবার ক্যামাক স্ট্রিটে ফিরে গিয়েছে। গত বার অভিষেকের মুখে শোনা গিয়েছিল আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের গ্রেফতারির দাবিও।
গত বছর ২৮ অগস্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার সঙ্গে অভিষেকের বক্তৃতার কিছু সূক্ষ্ম ফারাকও নজর কেড়েছিল রাজনৈতিক মহলের। এ বার তা দেখা গেল না। ২১ মিনিটের বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসক মমতার কাজকে বারংবার তুলে ধরে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানালেন অভিষেক। আবার মমতাও তাঁর ৪২ মিনিটের ভাষণে একাধিক বার অভিষেকের বক্তৃতার প্রশংসা করলেন। মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘অভিষেক সবটা খুব সুন্দর গুছিয়ে বলেছে। ও যেখানে শেষ করেছে, সেখান থেকেই আমি শুরু করব।’’ অভিষেক রাজনৈতিক ভাবে যে যে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, মমতাও সেগুলি বলেছেন আরও বিস্তারিত ভাবে এবং নিজের মতো করে। ফলে নেত্রী-সেনাপতির মধ্যে যে তালমিল ফিরে এসেছে, তা প্রতিফলিত হয়েছে দু’জনের বক্তৃতায়, মঞ্চের বিভিন্ন ছবিতে। তৃণমূলের কেউ মনে করতে পারছেন না, কবে অভিষেক নিজের বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পরে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মঞ্চ থেকে স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার মমতার বক্তৃতা শুরুর আগে তা-ও করেছেন অভিষেক। তালমিলের ছবি দেখা গিয়েছিল ২১ জুলাইয়ের মঞ্চেও। ২৮ অগস্ট তা আরও স্পষ্ট হল।