সুব্রত ধর, শিলিগুড়ি: ইতিহাসে এমএ করেছেন। দু’বার স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়েও সফল হননি। তবু জীবন সংগ্রামে হার মানেননি। বাবা-মা’র দেখানো মৃৎশিল্পের পথ বেছে নিয়ে স্বনির্ভর শিলিগুড়ির বধূ শ্যামলী পাল। গৃহকোণ সামলে তিনি গড়ছেন দেড় থেকে তিন ফুট উচ্চতার ৫০টি দুর্গা প্রতিমা। দু’হাতে সব সামলে তিনি হয়েছে উঠেছেন ‘জীবন্ত দুর্গা’। তবে লক্ষ্মীরভাণ্ডার ছাড়া অন্যকোনও সরকারি সহায়তা পান না তিনি। শ্যামলীর প্রত্যাশা, সরকারি সহায়তা মিললে নিজের শিল্পকলার প্রসার ঘটাবেন।
শিলিগুড়ি শহরের পরেশনগরে বধূর বাড়ি। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের চয়নপাড়ায় তাঁর বাবার বাড়ি। বর্তমানে তিনি সেখানেই রয়েছেন। কাঠামো গড়া থেকে মূর্তিতে রং করা, প্রতিমার চক্ষুদান সবই করছেন। তিনি বলেন, ঘোগোমালি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। ২০১৪ সালে স্নাতক পাশ করি। ২০১৭ সালে রবীন্দ্রভারতী থেকে ইতিহাসে এমএ করেছি। দু’বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েও সফল হইনি। সংসারের হাল ধরতে অ্যাকাউটেন্টের কাজে যোগ দিই। বিয়ের পর তা ছেড়ে দিলেও লড়াইয়ের ময়দান ছাড়িনি। বাবা-মা’র দেখানো পথেই প্রতিমা গড়ছি। এবার আড়াই ও তিন ফুটের প্রতিমা ২০টি করে এবং দেড় ফুটের ১০টি প্রতিমা গড়ছি। যা পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে দেখা যাবে।
চয়নপাড়ার মৃৎশিল্পী যোগেন্দ্রনাথ পাল ও চন্দনাদেবী। এই শিল্পী দম্পতির ছেলে নেই। তিন মেয়ের মধ্যে শ্যামলী ছোট। ফুটো টিনের চালের স্টুডিওতে মূর্তি গড়ে তাঁরা সংসার চালাচ্ছেন। যোগেন্দ্রনাথ বলেন, নড়বড়ে স্টুডিও। বৃষ্টির জলে অনেক সময় প্রতিমা গলে যায়। প্লাস্টিক বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকেও রক্ষা করা যায় না। অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়ে তিন মেয়েকে পড়িয়েছি। এখন ছোট মেয়ে শ্যামলী এই কাজ করছে। আমাদের স্টুডিও সামলাচ্ছে।
শ্যামলীর স্বামী বিশ্বজিৎ পাল ট্যাক্স কনসালটেন্সি ফার্মে কাজ করেন। খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়ে শ্যামলীর সকাল শুরু হয় সূর্যোদয়ের আগে। ভোরে উঠে স্বামী ও পাঁচ বছরের মেয়ে সহ পরিবারের সকলের সকালের খাবার তৈরি করেন। মেয়েকে স্কুলে পাঠান। সব্জি কাটেন, রান্না করেন, হেঁসেল সামলান। গৃহকোণের কাজের ফাঁকে প্রতিমার কাঠামো গড়েন। এভাবে দুপুর পর্যন্ত সময় কাটে। স্বল্প সময় বিরতি। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে প্রতিমা গড়া। নড়বড়ে স্টুডিওতে বসে এমন দিনলিপির কথা শোনান শ্যামলী। একই সঙ্গে তিনি ছবিও আঁকেন। তিনি বলেন, প্রতিমা গড়ে ও ছবি এঁকে স্বনির্ভর হয়েছি। তবে লক্ষ্মীরভাণ্ডার ছাড়া সরকারি কোনও সহায়তা মেলে না। রাজ্য সরকার কিছুটা সহায়তা করলে স্টুডিও’র পরিকাঠামো সংস্কার করতে পারি। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব।
শ্যামলীর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের একাংশ বলেন, শ্যামলী যেন এলাকার জীবন্ত দুর্গা। তাঁর লড়াই প্রমাণ করে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।